গত ২ নভেম্বর রাশিয়ার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি নিকোলাই পাত্রুশেভ এবং সি আই এ-এর ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস রুশ-মার্কিন সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য মুখোমুখি হন। ২০২১ সালের জুন মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে জেনেভা শীর্ষ সম্মেলনের পর উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদল সহ বার্নসের সাম্প্রতিক দু’দিনের মস্কো সফরের আগে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে দফায় দফায় যোগাযোগ ঘটেছে।
বার্নসের মস্কো সফরের কয়েক সপ্তাহ আগেই মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে মস্কোয় এসেছিলেন। এই সফরে নুল্যান্ড রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ, প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ এবং ডেপুটি চিফ অফ প্রেসিডেনশিয়াল স্টাফ দিমিত্রি কোজাকের (তিনি ইউক্রেন বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত) সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকগুলিকে ঠান্ডা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নতুন করে তৈরি হওয়া শীতলতা মেটাতে এবং মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্কে কিছুটা হলেও স্থিতিশীলতা আনতে উভয় পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বলা চলে।
নুল্যান্ডের রাশিয়া সফর একটি পারস্পরিক চুক্তির বিনিময়ে সম্ভব হয়েছিল, যেখানে এক দিকে রাশিয়ায় তাঁর প্রবেশাধিকারের উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, এবং বিনিময়ে রাশিয়ার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ কনস্তানতিন ভোরনতসভকে আমেরিকার ভিসা দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ইউক্রেন সংকটের পর উভয় পক্ষই অপর পক্ষের নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর যাতায়াতের নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল। যদিও নুল্যান্ডের সফরের পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য বিবৃতি জারি করা হয়নি এবং এর পাশাপাশি দূতাবাসের কর্মী সংকট বজায় থাকলেও উভয় পক্ষই এই সাক্ষাৎকে ইতিবাচক নজরে দেখেছে।
নুল্যান্ডের রাশিয়া সফর একটি পারস্পরিক চুক্তির বিনিময়ে সম্ভব হয়েছিল, যেখানে এক দিকে রাশিয়ায় তাঁর প্রবেশাধিকারের উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়, এবং বিনিময়ে রাশিয়ার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ কনস্তানতিন ভোরনতসভকে আমেরিকার ভিসা দেওয়া হয়।
নুল্যান্ড-উশাকভ বৈঠকে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে ‘খোলামেলা’ আলোচনা হয়েছে। ‘মিনস্ক চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে এবং ইউক্রেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির যৌথ স্বার্থ পূরণে’ পরিদর্শনকারী কূটনীতিক এবং কোজাকের মধ্যেকার সাক্ষাৎকারকে ফলপ্রসূ আলোচনার তকমা দেওয়া হয়। এর আগেই দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং পুতিনের শীর্ষ বৈঠকে দুই প্রধানই এই চুক্তিকে সমর্থন করেন। এই চুক্তির বাস্তবায়নে মতপার্থক্য এবং ইউক্রেনের তরফে বিরোধিতা সত্ত্বেও মিনস্ক চুক্তির ফের আলোচনায় ফিরে আসা রাশিয়ার মনে আশার সঞ্চার করেছে যে, ওয়াশিংটনের তরফে প্রক্রিয়াটির বাস্তবায়নের জন্য কিয়েভের মন পাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। নুল্যান্ড এবং কোজাক উভয়েই ইউক্রেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সম্মত হয়েছেন, যা এই বৈঠকের একটি ইতিবাচক ফলাফল।
যদিও উভয় পক্ষই সতর্ক ও আশাবাদী এবং অদূর ভবিষ্যতে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিরাট কোনও বাঁক বদলের আশা নেই, তবুও দু’পক্ষের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ অযাচিত ঝুঁকির বৃদ্ধি প্রশমনে ও সম্পর্কের মজবুতিকরণের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ পদক্ষেপ। এই দ্বিপাক্ষিক সমীকরণকে স্থিতিশীল করে তুলতে যে এখনও অনেক কাজ বাকি, তাও এই বৈঠকগুলি থেকে বোঝা গেছে। মস্কোতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকগুলি দূতাবাসের কর্মী সংকটের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার দূতাবাসে সীমিত সংখ্যক কূটনীতিকদের কাজ করার অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে অভিযুক্ত করেছে এবং এর পাশাপাশি বিগত বছরগুলিতে আরোপিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। গোপন তথ্য সংগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে আমেরিকা সে দেশে রাশিয়ার দুটি চত্বর বন্ধ করে দিয়েছিল। সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও সম্ভবত রুশ প্রস্তাবে আছে। অন্য দিকে আমেরিকার তরফে জানানো হয়েছে যে, স্থানীয় কর্মীদের নিয়োগের উপরে বিধিনিষেধের কারণে রাশিয়ায় ভিসা এবং কনস্যুলার পরিষেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না এবং তারা দুই দেশে কর্মরত কূটনীতিকদের সংখ্যার সমতার উপরে জোর দিয়েছে। আপাতত এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দুই পক্ষ সহমত হয়েছে।
জুন মাসে প্রেসিডেন্টদের শীর্ষ সম্মেলনের পরে, জুলাই এবং সেপ্টেম্বর মাসে দু’পক্ষের মধ্যে দুই দফায় কৌশলগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এক বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে এই আলোচনা হল। দ্বিতীয় দফার বৈঠকের পরে ‘ভবিষ্যতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের নীতি ও উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতা ও পদক্ষেপের কৌশলগত প্রভাব’ নিরূপণে দুটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ রকমই তৃতীয় একটি গ্রুপ গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও নুল্যান্ড সরাসরি এ বিষয়গুলি নিয়ে কোনও রফা করেননি, তবে এই ধরনের বিষয় যে আলোচনায় উঠে এসেছে, তা অনুমান করা যায়।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যৎ এবং নতুন কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি বা স্ট্র্যাটেজিক আর্ম রিডাকশন ট্রিটি-র (স্টার্ট) পাশাপাশি আফগানিস্তান, ইরান, কোরীয় উপদ্বীপ এবং সিরিয়া-সহ আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা ছাড়াও উভয় পক্ষেরই নতুন প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মহাকাশ সম্পর্কিত কর্মসূচি রয়েছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকলেও মধ্য এশিয়ায় ঘাঁটি তৈরি সংক্রান্ত আমেরিকান প্রচেষ্টার প্রতি রাশিয়া বিরুদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষই র্যানসমওয়্যার এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যের উপরে জোর দিয়ে সাইবার সুরক্ষার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা শুরু করেছে। যদিও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রের অস্ত্রায়নের মতো সর্বাধিক বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা হয়নি, তবুও অক্টোবর মাসে সাইবার সুরক্ষার বিপন্নতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবিত কর্মসূচির অর্থায়নে সমর্থনকারী অন্যান্য ৫৩টি দেশের সঙ্গে এই দুই দেশেরও সামিল হওয়া আশার আলো দেখিয়েছে।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকলেও মধ্য এশিয়ায় ঘাঁটি তৈরি সংক্রান্ত আমেরিকান প্রচেষ্টার প্রতি রাশিয়া বিরুদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছে।
গত কয়েক মাস ধরে এই সব পদক্ষেপ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছে যে উভয় দেশই তাদের মধ্যে একটি ‘কার্যকর এবং স্থিতিশীল সম্পর্ক’ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি তিনি বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগকে ‘গঠনমূলক’ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন যে, বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে একটি ‘সহজ এবং স্থিতিশীল সম্পর্ক’ গড়ে তুলতে চায়। সংকটময় দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের (জেক সুলিভান এবং নিকোলাই পাত্রুশেভ) এবং শীর্ষ সামরিক পদাধিকারীদের (জেনারেল মার্ক মিলি, চেয়ারম্যান, মার্কিন জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ এবং জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ, চিফ অফ দ্য রাশিয়ান জেনারেল স্টাফ) পর্যায়ে নিয়মিত আলাপচারিতায়ও উঠে এসেছে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাদের আটজন কূটনীতিককে বহিষ্কারের কারণে ১ নভেম্বর থেকে রাশিয়া ন্যাটোর সঙ্গে তার সম্পর্কে ইতি টানলেও আমেরিকা-রাশিয়ার মধ্যকার পারস্পরিক আলোচনা এখন অতিরিক্ত গুরুত্ব পাবে। রাশিয়া শুধু ব্রাসেলসে ন্যাটোতে তার স্থায়ী মিশনই স্থগিত করেনি, পাশাপাশি সরকারি অনুমোদন থেকে বঞ্চিত করার ফলে মস্কোতে কর্মরত ন্যাটোর কর্মীরাও ২৯ অক্টোবর শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ইতিমধ্যে আমেরিকা নজর ফিরিয়েছে চিনের দিকে এবং বর্তমানে তার প্রধান জাতীয় স্বার্থ ব্যতীত অন্য বিষয়গুলি নিয়ে তেমন ভাবে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। রাশিয়া ও চিনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলেও চিনের ক্রমবর্ধমান শক্তি সংহত করার মার্কিন প্রচেষ্টায় রাশিয়াকে এক সারিতে না বসানোর সুবিধে পেতে চলেছে মস্কো। এটি উভয় পক্ষকে তাদের দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগে কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে। বিগত মাসগুলিতে হওয়া সম্মেলনগুলির ফলে তাদের সুসম্পর্কের যে ভিত তৈরি হয়েছে, সেটিকে উভয় পক্ষের সাধারণ স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যমে আরও মজবুত করে তোলা যেতে পারে।
সৃজ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ে মৌলিক মতপার্থক্যের পাশাপাশি একাধিক বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেন, সাইবার সুরক্ষা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, ন্যাটোর ভূমিকা এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে মতানৈক্যের ফলে আমেরিকা ও রাশিয়ার সম্পর্কের টানাপড়েন এখনও বর্তমান। বিগত মাসগুলিতে সাইবার সুরক্ষা বিষয়ে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার তরফে গৃহীত সাম্প্রতিক কাউন্টার র্যানসমওয়্যার উদ্যোগে রাশিয়াকে ডাকা হয়নি। ‘উভয় পক্ষের মধ্যে টানাপড়েন বাড়ার আগাম অনুমান’ থেকেই সামগ্রিক পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা সহজে অনুমান করা যায়।
বিষয়টি তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন এ মাসের শুরুতে প্রধান প্রধান মার্কিন সেনেটররা দুই দেশে কর্মরত কূটনীতিকদের সংখ্যার মধ্যে সমতা বিধানের উদ্দেশ্যে আমেরিকান কূটনীতিকদের নতুন করে ভিসা না দেওয়া হলে ৩০০ রুশ কূটনীতিককে দেশ থেকে বহিষ্কার করার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি দিয়েছেন। মস্কো ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, যদিও তারা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে চায় না, তবুও রুশ-বিরোধী কার্যকলাপ রাশিয়ায় মার্কিন কূটনীতিকদের উপস্থিতি চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে।
অন্য দিকে জেনেভা সম্মেলনের পরবর্তী সময়ে আমেরিকা-রাশিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কে নিঃসন্দেহে উন্নতি হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও জেনেভা শীর্ষ সম্মেলনে কৌশলগত স্থিতিশীলতা এবং সাইবার সুরক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে হওয়া সমঝোতার পাশাপাশি যৌথ স্বার্থ পূরণে আধিকারিক/ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এবং তা সাইবার সুরক্ষা সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে দুই দেশের সামিল হওয়ার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী কালে এটি নিঃসন্দেহে দুই দেশের মধ্যেকার পরিস্থিতির উন্নতির পরিচায়ক যা ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া সহজতর হয়ে ওঠার আশা জাগাচ্ছে। এখন এটাই দেখার যে, এই দ্বিপাক্ষিক কথোপকথন আগামী মাসগুলিতে কার্যকর চুক্তিতে রূপান্তরিত হয় কি না এবং সেটিই মস্কো ও ওয়াশিংটনের প্রকৃত অভিপ্রায়ের নির্ণায়ক হতে চলেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.