প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, সামরিক নেতা ও ছাত্র কর্মীদের মধ্যে বৈঠকের পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্বর্তী সরকার সমস্যাজর্জরিত বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ‘সংবিধানকে সমুন্নত রাখা, সমর্থন করা ও রক্ষা করা’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউনুস আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ তাঁর সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতির বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে। শেখ হাসিনার পতন হলেও আসল চ্যালেঞ্জ এ বার শুরু হতে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন। এক নতুন আশাবাদ লক্ষ করা গেলেও তা আদতে গভীর ভাবে বিভক্ত সমাজ এবং রাজনীতির মধ্যে চাপা পড়েছে।
নিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে দ্বন্দ্ব পর্যন্ত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসকে তাঁর নতুন ভূমিকার জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং হিন্দু ও সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে দেশের অবস্থার দ্রুত স্বাভাবিকীকরণের আশা প্রকাশ করেছেন। ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কারণ ভারতের দীর্ঘমেয়াদি মিত্র হাসিনা অবজ্ঞার সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। গত ১৫ বছরের নিশ্চয়তার পরিবর্তে এক অজানা বাস্তবতা উঠে আসছে। নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে তার অংশীদারিত্বে বিনিয়োগ করেছিল এই আস্থা রেখেই যে, হাসিনার শাসন ভারতকে হতাশ করবে না। এর ফলস্বরূপ, গড়ে ওঠা দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব কেবল পরীক্ষামূলক চ্যালেঞ্জের সমাধানই করেনি, বরং দুই দেশের সম্পর্ক বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত অঞ্চলে একটি নোঙর হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।
গড়ে ওঠা দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব কেবল পরীক্ষামূলক চ্যালেঞ্জের সমাধানই করেনি, বরং দুই দেশের সম্পর্ক বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত অঞ্চলে একটি নোঙর হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।
যাই হোক, সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কেন্দ্রীভূত করা এবং বিরোধী দলকে প্রান্তিক করার হাসিনার প্রবণতা বাংলাদেশের বিবর্তনকে একটি পরিণত গণতন্ত্রে উন্নীত হতে দেয়নি। হাসিনা কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লির বিকল্পগুলিও হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এখন ভারতকে এ কথাই সুনিশ্চিত করতে হবে যে, দেশটি ঢাকার নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে যেন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা
হাসিনাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে আনার পরে ভারত যে তার মিত্রের পাশে দাঁড়াবে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ হল বাংলাদেশের উদীয়মান রাজনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। এটি শুধুমাত্র দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং অত্যন্ত অস্থির সীমান্ত এলাকাকে স্থিতিশীল করার তাত্ক্ষণিক চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলার জন্যও জরুরি।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্তটি প্রধানত পোরাস বা বহু ফাঁকবিশিষ্ট। এই সীমান্ত পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্য বরাবর বিস্তৃত, যে এলাকাগুলি একসময় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির চলাচলের পথ ছিল। যাই হোক, হাসিনার সময়ে সীমান্ত তুলনামূলক ভাবে শান্ত ছিল। কারণ এই দলগুলিকে বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজে পেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার ইতিমধ্যেই অশান্তির খবর পাওয়া গিয়েছে এবং নয়াদিল্লি তার সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীকে রীতিমতো সতর্ক থাকতে বলেছে। পাকিস্তান এবং চিনের সঙ্গে সীমান্তে ভারত গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ায় বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
চরমপন্থা একটি উদ্বেগ হয়েই রয়েছে
বাংলাদেশে ইসলামি উগ্রবাদের উত্থান আর একটি চ্যালেঞ্জ, যার দিকে নয়াদিল্লি নিবিড় ভাবে নজর রাখবে। হাসিনার আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠী জমি খুঁজে পেয়েছিল। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরীর এবং জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর (জেএমবি) মতো গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অনেকেরই ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স-সহ (আইএসআই) পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এই সংযোগগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার নতুন সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছে। জামাতে ইসলামীকে হাসিনার পতনের নেপথ্যে থাকা সাম্প্রতিক দাঙ্গার মূল প্ররোচনাকারী হিসাবে দেখা হয়। হাসিনা সরকার ২০১৩ সালে এই দলটিকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে।
হাসিনার আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠী জমি খুঁজে পেয়েছিল।
হিন্দুদের পদ্ধতিগত ভাবে লক্ষ্যবস্তু করা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। কারণ এ হেন পরিস্থিতি ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির যে কোনও রকমের সম্পৃক্ততায় ব্যাঘাত ঘটাবে। উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই একে অপরের সম্পর্কে দ্রুত অবনতিশীল ধারণাগুলিকে সুচারু ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখা
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশ বাণিজ্য ও সংযোগ বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করেছে, যাতে বঙ্গোপসাগরকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। আজকের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব গঠনে রাজনৈতিক আস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ চলরাশি। ঢাকার নতুন সরকার দিল্লিতে আস্থা তৈরি করতে না পারলে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার পুরনো দৃষ্টান্ত পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হবে না। এটি ভারতের জন্য এক প্রকার ক্ষতি। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে অর্থনৈতিক ভাবে গতিশীল করার ক্ষমতা শক্তিশালী ভারত-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। তবে এটি বাংলাদেশের জন্যও ক্ষতির কারণ হবে, যে দেশটি তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার দুই আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদার অর্থাৎ ভারত এবং চিনকে এত দিন কার্যকর ভাবে ব্যবহার করে এসেছে।
বঙ্গোপসাগরের ঘোলা জলে পাকিস্তান এবং চিনের মাছ ধরার চেষ্টা সম্পর্কে নয়াদিল্লি সতর্ক থাকবে। ভৌগোলিক যুক্তি দর্শায় দেয় যে, দিল্লি এবং ঢাকা উভয়কেই তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কতটা চাপানউতোর ছিল, তা ভুলে যাওয়া সহজ। কিন্তু এমন এক সময়ে যখন ভারত নিজেকে একটি নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে দেখছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ায় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলিকে ভারত আর কোনও মতেই উপেক্ষা করতে পারে না।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.