ভারতে ও অন্যত্র জনকল্যাণমূলক ধারণার প্রসার মহিলাদের উপর মনোনিবেশকারী কল্যাণমূলক নীতি নির্ধারণে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। মহিলারা কল্যাণমূলক পরিষেবার নিরিখে প্রধান প্রাপক। কারণ তাঁরা পুরুষদের তুলনায় দরিদ্রতর। এটি এমন একটি বাস্তবতা যাকে ‘দারিদ্র্যের নারীকরণ’-এর আড়ালে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, ‘নারীরা বিশ্বের দরিদ্র’ এবং অতিমারি নারীদের আরও দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এটি আংশিক ভাবে দর্শায় যে, কেন চলমান বিধানসভা নির্বাচনে নারীদের হাতে শর্তহীন নগদ অর্থ প্রদানের ধারাটি প্রধান প্রবণতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এই কর্মসূচিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হল মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক এবং রাজস্থানে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। এই নির্বাচনী কৌশলের প্রধান লক্ষ্যই হল সমগ্র স্তরব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলি দ্বারা মহিলা ভোটারদের প্রভাবিত করা।
সুবিধাভোগী হিসাবে মহিলাদের উপর পিতৃতান্ত্রিক মনোযোগ
মধ্যপ্রদেশের লাডলি বেহনা যোজনা এই বছরের শুরুতে বাস্তবায়িত হয়েছে, যেখানে বার্ষিক ২.৫ লক্ষ টাকার কম উপার্জনক্ষম পরিবারের মহিলা সুবিধাভোগীদের মাসিক ১২৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। কর্নাটকের গৃহলক্ষ্মী প্রকল্পকে - যেখানে পরিবারের অভিভাবক মহিলাদের প্রতি মাসে ২০০০ টাকা করে দেওয়া হয় – সেই রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলের জন্য একটি প্রভাবশালী কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে।
রাজস্থানে সরকার প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকস্থানীয় মহিলাদের বছরে এককালীন ১০,০০০ টাকা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। একই ভাবে তামিলনাড়ু সম্প্রতি কলাইগনার মাগালির উরিমাই স্কিমের বাস্তবায়ন করেছে, বার্ষিক ২.৫ লক্ষ টাকার কম উপার্জনক্ষম পরিবারের ২১ বছরের বেশি বয়সি সকল মহিলাকে মাসিক ১০০০ টাকা করে ভাতা প্রদান করা হয়।
‘লাডলি বেহনা’ এবং ‘গৃহলক্ষ্মী’র মতো কর্মসূচিগুলির নাম ইচ্ছাকৃত ভাবে সুনির্দিষ্ট পিতৃতান্ত্রিক জনকল্যাণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণকেই উস্কে দেয়। এই সব প্রকল্পে সেই সব মহিলাকেই সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়, যাঁরা অর্থপূর্ণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত। পিতৃতন্ত্রের ভাষায়, পুরুষরা মা, স্ত্রী এবং কন্যা হিসাবে নারীদের ভূমিকার উপর জোর দেয় এবং ‘তাদের কঠোর পরিশ্রম’কে স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করে।
রাজনৈতিক দলগুলি এই কর্মসূচিগুলির জন্য তাদের বিজ্ঞাপনী ভাষা যেমন ভাবেই তৈরি করুক না কেন, এ কথা অবশ্যই বলা জরুরি যে, অনেকাংশে অবৈতনিক গার্হস্থ্য এবং পরিচর্যার কাজের অসম ভারের কারণে ভারতে মহিলারা বেতনভুক্ত কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
কোভিড-১৯ অতিমারির পরে নগদ অর্থ প্রদানের সম্প্রসারণ
কোভিড-১৯ অতিমারি এক অর্থে দর্শিয়েছে যে, দেখভাল করার বোঝা কী ভাবে নারীদের দারিদ্র্যের জন্য প্রধানত দায়ী। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে অতিমারির দিনগুলির শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকার একটি আপৎকালীন শর্তহীন নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা স্থানান্তর করে, যা বিশ্বের বৃহত্তম। এটিতে দেশের ২০৬ মিলিয়ন নারী সুবিধাভোগীদের তিন মাসের জন্য ৫০০ টাকা করে অর্থ প্রদান করা হয়। এই উদাহরণই দর্শিয়েছে যে, সরকার পরিবারের উপর অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাব হ্রাস করতে এবং মহিলা নাগরিকদের জন্য একটি ভাল সামাজিক নিরাপত্তা বলয় প্রদান করতে সক্ষম।
কেন্দ্রীয় সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অসম দেশের মধ্যে শর্তহীন নগদ অর্থ প্রদানের প্রক্রিয়া প্রবর্তনকারী অগ্রণী রাজ্য হয়ে ওঠে। অসম ২০২০ সালে অরুণোদয় স্কিম চালু করে, যেখানে ওষুধ, ফল, শাকসবজি, ডালের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য মহিলা সুবিধাভোগীদের প্রতি মাসে ১২৫০ টাকা প্রদান করা হয়।
২০২১ সালে শুরু হওয়া পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মী ভাণ্ডার প্রকল্পটিতে মাসে মাসে সংরক্ষণের আওতার বাইরে থাকা মহিলাদের জন্য ৫০০ টাকা এবং এসসি ও এসটি শ্রেণির (তফসিলি জাতি ও উপজাতি) মহিলাদের জন্য ১০০০ টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২১ সালের শেষের দিকে যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন শুরু হয়, তখন এই প্রকল্পটি অর্থপ্রদান করে নতুন ভোটদাতাদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে।
অন্যান্য দেশের নানাবিধ প্রমাণ দর্শিয়েছে যে, ভারতে রাজনৈতিক দলগুলি এই স্বার্থসিদ্ধির উপায়কে সমর্থন করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, নগদ অর্থ প্রদান এবং লক্ষ্যবিশিষ্ট কর্মসূচিগুলি নির্বাচনী আচরণকে প্রভাবিত করে, ভোটারের উপস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটায় এবং ক্ষমতাসীন প্রশাসনের পক্ষে মতদানকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, রান্নার গ্যাসের লভ্যতা, জীবিকা এবং পেনশন প্রদানকারী কর্মসূচিগুলির জন্য প্রত্যক্ষ বেনিফিট ট্রান্সফারের অধীনে মহিলাদের হাতে শর্তসাপেক্ষ নগদ অর্থ প্রদানের প্রক্রিয়ার ভিত্তি ভারতে গত এক দশক ধরে শক্তপোক্ত হয়েছে এবং বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, তা নারীদের ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
শর্তহীন নগদ অর্থ প্রদান, যা ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম-এর (ইউবিআই) ধারণাকে কাজে লাগায়, তা অতিমারির সময় থেকে একটি জনপ্রিয় নীতি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউবিআই বা একটি ন্যূনতম আয়ের গ্যারান্টি শুধুমাত্র ভারতেই নয়, অন্যান্য যে সকল দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে, সর্বত্রই দীর্ঘমেয়াদে সরকারগুলির জন্য এ হেন প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে কঠিন করে তুলেছে।
এ হেন প্রকল্পের প্রবক্তারা যুক্তি দর্শিয়েছেন যে, অতিমারির ফলে প্রকাশ্যে উঠে আসা ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, জলবায়ু সঙ্কট, জীবনযাত্রার ব্যয়-সঙ্কট এবং প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে জীবিকা নির্বাহের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি সম্মিলিত ভাবে মৌলিক আয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহিলা ভোটারদের বক্তব্য
ভারতে এই ধরনের প্রবণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সূচনা করেছে এবং তা হল একটি প্রধান নির্বাচনী গোষ্ঠী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মহিলা ভোটারদের উত্থান এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যক রাজ্য নির্বাচনে পুরুষদের তুলনায় নারী ভোটারদের মতদানের হার বেশি। ভারতে আরও বেশি পরিমাণে মহিলা শিক্ষিত হয়ে উঠছেন এবং তৃণমূল স্তরের নেতা ও স্ব-সহায়ক গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে সামাজিক ভাবে ক্ষমতায়িত হচ্ছেন, যে প্রবণতা দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে।
তথ্যের দিকে নজর দিলে চলমান নির্বাচনে নারী ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধির কথাই স্পষ্ট হয়ে যায়। মধ্যপ্রদেশে মহিলা ভোটারদের মতদান ১৯৬২ সালে ২৯.১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে অবিশ্বাস্য ভাবে ৭৪.১ শতাংশে পৌঁছেছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতে, রাজস্থানের ৫.২৬ কোটি ভোটারের মধ্যে ২.৫১ কোটি ভোটারই মহিলা।
পরিবারে পুরুষদের প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে নারীরা অধিক সংখ্যায় মতদানে অংশ নিচ্ছেন এবং স্বেচ্ছায় মতদানের বিষয়টি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের নীতিগুলির সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তবে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের পরিমাণ মহিলা মতদানের পরিমাণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি।
পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানগুলি বাদে - যেখানে প্রায় ৪৫ শতাংশ মহিলাই স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করেন এবং যা বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম - মহিলাদের আইনসভামূলক সংস্থাগুলিতে কম প্রতিনিধিত্বই রয়েছে। মহিলা সংরক্ষণ বিলে লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং মহিলাদের কম প্রতিনিধিত্বের সমস্যাটি মোকাবিলা করার জন্য ও মহিলা ভোটারদের অনুকূলে আনার জন্য এই বিল পাশের বিষয়টিকে একটি বাজি বলা যেতে পারে।
নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ব্যবধানও ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে। অর্থনীতিতে ভারতীয় নারীদের অংশগ্রহণ এবং জমি ও সম্পদে প্রবেশাধিকার নিরঙ্কুশ ভাবে অব্যাহত রয়েছে। ভারতে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হারের ব্যবধান অপরিবর্তিত এবং সরকারের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১-২২ সালে ৭৭.২ শতাংশ পুরুষ এবং ৩২.৮ শতাংশ মহিলা শ্রমশক্তির অংশ ছিল।
প্রতিবেদনটিতে সামাজিক কারণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কর্মক্ষেত্রে বেতন ও সুযোগের নিরিখে লিঙ্গ বৈষম্যকে দায়ী করা হয়েছে। এই বৈষম্যগুলি মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের প্রয়োজন হলেও শর্তহীন নগদ অর্থ প্রদান পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যার একটি প্রতিকার প্রদান করতে পারে।
সুনয়না কুমার অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.