নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) নিয়মগুলিকে অবহিত করার বিষয়টি কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিরোধ অব্যাহত থাকায়, ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য ‘নিপীড়িত’ সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীলঙ্কার তামিলদের (এসএলটি) অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে। সরকার প্রাথমিক ভাবে ব্যাখ্যা করেছিল যে, কেন এসএলটি সম্প্রদায়কে ইচ্ছাকৃত ভাবেই সিএএ-র আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। সরকার দর্শিয়েছে যে, এসএলটি-র মানুষদের যদি ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তা হলে এই সম্প্রদায়ের মানুষজন তাঁদের নিজ দেশ অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় আরও নিপীড়নের সম্মুখীন হবেন এবং ফলে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হবেন।
এসএলটি সম্প্রদায় শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সম্প্রদায় হলেও তামিলনাড়ুর সঙ্গে তাদের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক যোগসূত্র রয়েছে। পূর্ব ভারত থেকে নির্বাসিত যুবরাজ বিজয়ের বংশধর সিংহলি-বৌদ্ধদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। এ কথা প্রায় সর্বজনবিদিত যে, সিংহলিদের মাতৃভাষা পালি, যা কি না ভারতীয় উত্সজাত। তা সত্ত্বেও জাতিগত আধিপত্যের বিষয়ে এক অবিরাম দ্বন্দ্ব রয়েছে, যা প্রায় ৩০ বছরব্যাপী সহিংস যুদ্ধের পরে শেষ হয়েছিল। এই যুদ্ধে এলটিটিই এসএলটি-র স্ব-আরোপিত ‘একক প্রতিনিধি’ হিসাবে ২০০৯ সালের মে মাসে পরাজিত হয়েছিল।
তামিল-বিরোধী জাতিগত হিংসার প্রথম দিনগুলিতে অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের ‘ব্ল্যাক জুলাই’ ঘটনার পরে রাষ্ট্রের সঙ্গে সিংহলি দুর্বৃত্তদের দ্বন্দ্বে হত্যা, ধর্ষণ ও লুঠপাটের হাত থেকে বাঁচতে হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা এবং শিশু মাছ ধরার নৌকোয় চেপে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেই সময়ে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল তিন লক্ষেরও বেশি। ২০২৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ এই শরণার্থীর সংখ্যা অবশ্য প্রায় ৯২ হাজারে নেমে আসে। এই শরণার্থীদের মধ্যে ৫৮,৪৫৭ জন মানুষ তামিলনাড়ুর সরকার পরিচালিত শিবিরে এবং ৩৩,৭৩৫ জন মানুষ শরণার্থী শিবিরের বাইরে বসবাস করতে শুরু করেন। বিশেষ করে নরওয়ের সহায়তায় শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধবিরতির সময়কালে (২০০২-২০০৬) এবং নির্ণায়ক ‘চতুর্থ ইলম যুদ্ধ’-র (২০০৯) সমাপ্তির পরে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায় ফিরে যান।
২০২৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ এই শরণার্থীর সংখ্যা অবশ্য প্রায় ৯২ হাজারে নেমে আসে। এই শরণার্থীদের মধ্যে ৫৮,৪৫৭ জন মানুষ তামিলনাড়ুর সরকার পরিচালিত শিবিরে এবং ৩৩,৭৩৫ জন মানুষ শরণার্থী শিবিরের বাইরে বসবাস করতে শুরু করেন।
প্রায় প্রথম দিন থেকেই এসএলটি শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য নানাবিধ দাবি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রয়াত ডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এম করুণানিধি এবং করুণানিধির ছেলে ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন। নিজের শাসনামলে এআইএডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এডাপ্পাদি কে পালানিস্বামী শরণার্থীদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব চেয়েছিলেন। যাই হোক, কেন্দ্রীয় সরকার অনুরোধ বা বিকল্প বিবেচনা না করার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
প্রথম বড় সিদ্ধান্ত
কেন্দ্র মালাহায়া তামিলদের ঘটনা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে যুক্তি দর্শিয়েছে। এই মানুষজনদেরই এক সময়ে ব্রিটিশরা দক্ষিণ তামিলনাড়ু থেকে শ্রীলঙ্কার (তৎকালীন সিলোন) মধ্য উচ্চভূমিতে চা বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল।
১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের প্রথম প্রধান সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল মালায়াহা তামিলদের ‘স্টেটলেস’ বা ‘রাষ্ট্রহীন’ করা। দেশভাগের মানসিকতায় জর্জরিত ভারত প্রতিবেশের দেশগুলির ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ না করার অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সিলোন মালায়াহা তামিলদের ‘রাষ্ট্রহীন’ করার পরে ভারত তাঁদের আশ্রয় দেওয়া এবং গ্রহণ করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছিল। ১৯৬৪ সালের সিরিমা-শাস্ত্রী চুক্তির মাধ্যমে এমনটা করা সম্ভব হয়েছিল, যখন প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকে (সিলোন) এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী (ভারত) তিন লক্ষ মানুষকে সিলোনের নাগরিকত্ব দিতে এবং পাঁচ লক্ষ পঁচিশ হাজার মানুষকে ভারতে প্রত্যাবাসন দিতে সম্মত হন। অন্তর্বর্তী সময়ে বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার) থেকে শরণার্থীরাও ভারতে আসতে শুরু করেছিল এবং এর জন্য একটি বিস্তৃত কাঠামোর প্রয়োজন ছিল।
আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা
ভারত সম্ভবত কয়েকটি বৃহৎ এবং প্রভাবশালী দেশের অন্যতম, যে দেশে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় প্রবাসীর উপস্থিতি রয়েছে, যাঁরা ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেননি। একই সঙ্গে তাঁরা শরণার্থীদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করেননি, যা আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা ও প্রভাবের জন্ম দিতে পারত, যা মানবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি রাজনৈতিক। এই প্রভাব বছর এবং দেশের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রাথমিক ভারতীয় ধারণাকে সঠিক বলে প্রমাণ করেছে।
রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিপরীতে অস্থায়ী আশ্রয়ের সন্ধানকারীদের জন্য নিজের দেশের সীমানা উন্মুক্ত করার বিষয়ে মানবাধিকার ও শরণার্থী ত্রাণ সংক্রান্ত বেশিরভাগ পশ্চিমী বক্তাদের চেয়ে ভারত সব সময়ই অনেক বেশি মানবিক এবং মানবতাবাদী থেকেছে।
গত কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন সত্ত্বেও নানাবিধ নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিতই রয়েছে। তবে ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচসিআর) দেশে তাদের কার্যালয় রাখার অনুমতি দিয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিপরীতে অস্থায়ী আশ্রয়ের সন্ধানকারীদের জন্য নিজের দেশের সীমানা উন্মুক্ত করার বিষয়ে মানবাধিকার ও শরণার্থী ত্রাণ সংক্রান্ত বেশিরভাগ পশ্চিমী বক্তাদের চেয়ে ভারত সব সময়ই অনেক বেশি মানবিক এবং মানবতাবাদী থেকেছে।
শর্ত নির্মাণ করা
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে শ্রীলঙ্কার তামিলদের জন্য ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে দৃঢ় আপত্তি রয়েছে। কারণ তখন শ্রীলঙ্কায় সিংহল-বৌদ্ধ কট্টরপন্থীদের প্রচেষ্টা হবে এসএলটি সম্প্রদায়ের জন্য অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে তাঁরা বেশির ভাগই ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। বিতর্কের প্রথম দিন থেকে শুরু করে জাতিগত সমস্যা সংক্রান্ত প্রতিটি আলোচনা বা বিতর্কে সিংহলি দণ্ডমুণ্ডের আগ্রাসী কর্তারা এই বক্তব্য তুলে ধরার কোনও সুযোগই বাকি রাখেনি যে, মুসলিম-সহ তামিল ভাষার মানুষরা ভারতে আশ্রয় নিলেও সেই সব শরণার্থীর নিজের ভূমি থাকবে আসলে শ্রীলঙ্কাতেই।
পাঁচ, ছয় এবং পরে আটের দশকে এসএলটি সম্প্রদায়ের নিপীড়নের মূল কারণগুলির মধ্যে এই যুক্তিটিই নিহিত ছিল। তাই শ্রীলঙ্কায় নির্যাতিত তামিলদের ভারতীয় নাগরিকত্ব না দেওয়ার বিষয়ে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে ন্যায্য অনিচ্ছা প্রদর্শন করা হয়েছে। কারণ এমনটা হলে তা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরে নিপীড়নের একটি অন্যতম কারণ হয়ে উঠবে, যা আরও একটি মানবিক সঙ্কটের দিকে চালিত করতে পারে এবং একই সঙ্গে এমন এক কূটনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, যা অতীতের মতো সহজে সমাধান করা সম্ভব হবে না এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠবে।
যাই হোক, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং আবেদনকারী মামলাটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও তথ্য এবং পরিসংখ্যান প্রদান করেননি বলে আদালত বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে মাদ্রাজ হাইকোর্ট সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইনের অধীনে তামিলনাড়ুর শিবিরে জন্ম নেওয়া শ্রীলঙ্কার শরণার্থীদের শিশুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই আবেদনটি সিএএ বিধিগুলির সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার আগে দাখিল করা হয়েছিল। যাই হোক, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং আবেদনকারী মামলাটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও তথ্য এবং পরিসংখ্যান প্রদান করেননি বলে আদালত বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেয়। ফলে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, বিষয়টি প্রমাণিত হয় আদালত অনুরূপ আবেদন বিবেচনা করে দেখতে পারে।
চুক্তির বাধ্যবাধকতা
এ কথা পরিহাসের বিষয় যে, সিরি-শাস্ত্রী চুক্তির অধীনে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতে প্রত্যাবর্তন করা মালায়াহা তামিলদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে নাগরিকত্ব আইনের অধীনে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়নি। তাঁরাও সিএএ-র অধীনে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৫,০০০। তাঁদের ক্ষেত্রে দ্বীপরাষ্ট্রে এসএলটি আত্মীয়দের উপর করা অব্যাহত নিপীড়নের সঙ্গে সম্পর্কিত যুক্তি গুরুত্ব হারাতে পারে। কারণ তাঁরা কয়েক দশক আগে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অধীনে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ করেছিল যে, ভারত এখনও ১৯৬৪ চুক্তির অধীনে সেই চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলি পূরণ করেনি। আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে, মালায়াহা তামিল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী জীবন থন্ডামান বলেছেন যে, মালায়াহা তামিলদের প্রতিটি সদস্যের অধিকার ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার জন্য শ্রীলঙ্কা ও ভারত উভয়কেই দায়িত্ব নিতে হবে।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসের শুরুতে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি জি স্বামীনাথন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে, ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি (সিএএ) যেমন পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ‘নিপীড়িত সংখ্যালঘু’দের জন্য প্রযোজ্য, তেমনই অন্যান্য (তামিলভাষী) সেই অভিবাসীদের উপরেও প্রয়োগ করা আবশ্যক, যাঁরা বংশগত ভাবে ভারতে রয়েছেন, একই ভাষায় কথা বলেন এবং একই সংস্কৃতির অংশ।
অনেক এসএলটি শরণার্থী ভারতীয় পাসপোর্টের প্রত্যাশা করেন, যাতে তাঁরা ‘রাজনৈতিক শিকার’-এর আড়ালে ‘অর্থনৈতিক শরণার্থী’ হিসেবে পশ্চিমে পাড়ি জমাতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হল, এই বিষয়টি কি শ্রীলঙ্কার তামিল-ভাষী জনগণের জন্য ‘স্টেটলেসনেস টু স্টেটলেসনেস’ বা ‘রাষ্ট্রহীন থেকে আর এক রাষ্ট্রহীনতা’য় পর্যবসিত হওয়ার ঘটনা? না কি তাঁদের উদ্বেগ এবং প্রয়োজনীয়তাগুলি সমাধান করার জন্য কেন্দ্রের কিছু উদ্ভাবনী উপায় বিবেচনা করা উচিত? এতে বেশিরভাগ মালায়াহা তামিল প্রত্যাবাসনকারী বৈধ নথি বা নাগরিকত্বের প্রত্যাশা করছেন, যা শুধুমাত্র ভারতে তাদের বৈধতা দেবে। অনেক এসএলটি শরণার্থী ভারতীয় পাসপোর্টের প্রত্যাশা করেন, যাতে তাঁরা ‘রাজনৈতিক শিকার’-এর আড়ালে ‘অর্থনৈতিক শরণার্থী’ হিসেবে পশ্চিমে পাড়ি জমাতে পারেন। তাঁরা শ্রীলঙ্কায় ফেরার একমুখী ভ্রমণ সংক্রান্ত নথিতে ততটাও আগ্রহী নন। কারণ এত বছর পর দেশে ফিরলে তাঁদের আর পাসপোর্ট প্রদান করা হবে না, এই ভয়ই এখন তাঁদের কুরে কুরে খাচ্ছে।
এন সত্য মূর্তি চেন্নাইভিত্তিক নীতি বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.