উন্নয়নমূলক সহযোগিতার উদ্দেশ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে দেশগুলিকে সাহায্য করা। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি তুলনামূলক নতুন ধারণা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটি গুরুত্ব পায়, যা দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, তার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং পুনর্নির্মাণের মাত্রার প্রয়োজনীয়তার কারণে জন্ম নেয়। এবং এর ফলাফল ছিল মার্শাল প্ল্যানের মতো উন্নয়নমূলক সহযোগিতা পরিকল্পনা – পশ্চিম ইউরোপে বিদেশি সহায়তা প্রদানের জন্য ১৯৪৮ সালে প্রণীত একটি আমেরিকান উদ্যোগ – এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও পরে আন্তর্জাতিক চুক্তি। প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির প্রাক্তন উপনিবেশগুলির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়কার প্রভাবের ক্ষেত্রগুলি অটুট রাখতে এবং পরবর্তী কালে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধান, বাজার ও সংস্থানগুলিতে প্রবেশাধিকার এবং অন্য অনেক কিছু সুনিশ্চিত করতে উন্নয়নমূলক সহায়তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং এমনকি জাতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য উন্নয়নমূলক সহযোগিতা এক মৌলিক বিষয়।
প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির প্রাক্তন উপনিবেশগুলির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়কার প্রভাবের ক্ষেত্রগুলি অটুট রাখতে এবং পরবর্তী কালে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধান, বাজার ও সংস্থানগুলিতে প্রবেশাধিকার এবং অন্য অনেক কিছু সুনিশ্চিত করতে উন্নয়নমূলক সহায়তাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
কূটনীতির একটি সাধনী হিসাবে ব্যবহৃত উন্নয়নমূলক সহযোগিতাকে উন্নয়নমূলক কূটনীতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যা এমনতর ত্রাণের পুনঃপ্রয়োগকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সরকারি কূটনীতির উদ্দেশ্যের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করে। কূটনীতির একটি সাধনী হিসেবে আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতার জন্য উন্নয়নমূলক সহযোগিতাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। দাতা দেশগুলি আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) বা অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস-এর (আসিয়ান) মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলিকে সমর্থন জোগাতে এবং বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়গুলিতে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রচার চালানোর কাজে সহায়ক হতে পারে। এই ভাবে উন্নয়নমূলক সহায়তা বিদ্যমান জোট বজায় রাখার এবং নতুন জোট তৈরি করার একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা, বিশেষ করে উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলির মধ্যে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজেদের মধ্যেও সম্পর্ক গড়ে তোলে। কারণ এটি বৈদেশিক নীতি এবং উন্নয়নমূলক সহযোগিতার মধ্যে সংযোগ তৈরি করে। ভূ-কৌশলগত এবং ভূ-অর্থনৈতিক উদ্বেগের সংমেল উন্নয়নমূলক সহযোগিতার একটি অনিবার্য এবং অবিচ্ছেদ্য উপাদান।
উন্নয়নমূলক সহযোগিতার ভূ-রাজনীতি
‘পরার্থপরায়ণ উন্নয়নমূলক সহায়তা’র অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যার লক্ষ্য স্থায়িত্বের নীতিগুলি অনুসরণ করে বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করা। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সশক্ত করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন জোগানোর জন্য প্রস্তুত সহায়তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেগুলি মানব পুঁজি গঠনে সহায়তার জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি; উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি ভাগ করে নেওয়ার প্রচার; এবং মানবিক সঙ্কটের সম্মুখীন দেশগুলিকে সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করে।
যদিও উন্নয়নমূলক সহযোগিতার ভূ-রাজনীতির একটি জটিল ইতিহাস রয়েছে। কারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত বিষয়গুলি ত্রাণ বরাদ্দ এবং বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই উন্নয়নের প্রচারের জন্য ত্রাণ দরকারি উপকরণ হলেও ত্রাণ বণ্টনের নেপথ্যে অনুপ্রেরণা প্রায়শই শুধু মাত্র উন্নয়নমূলক লক্ষ্যগুলির পরিবর্তে ভূ-রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিবেচনার দ্বারা চালিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তন এবং জটিলতা… যা-ই হোক না কেন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় আদানপ্রদান রিয়েল পলিটিক বা বাস্তব রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়ে এসেছে এবং অব্যাহত থাকবে। এবং যত দিন বাস্তব রাজনীতি বিদ্যমান থাকবে, তত দিন উন্নয়নমূলক সহযোগিতার পিছুটান থাকবে। কিন্তু পিছুটানের অনুপস্থিতির অর্থ সর্বদা সহযোগিতার আরও নৈতিক বা গ্রহণযোগ্য রূপকে দর্শায় না।
ত্রাণের মূল (নৈতিক) লক্ষ্য–উন্নয়ন টিকিয়ে রাখা এবং দারিদ্র্য হ্রাস করার জন্য ত্রাণের রাজনীতির একটি মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ এটি রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা এবং আরও যথাযথ ভাবে বললে, বিশ্বব্যবস্থাকে চালনাকারী ভূ-রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা এবং একই সঙ্গে ত্রাণ বিতরণের নেপথ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলির একটি অনুমান ত্রাণ কার্যকারিতার একটি পরিমাপক হিসাবে কাজ করতে পারে। অন্য কথায় বললে, ত্রাণের মূল (নৈতিক) লক্ষ্য–উন্নয়ন টিকিয়ে রাখা এবং দারিদ্র্য হ্রাস করার জন্য ত্রাণের রাজনীতির একটি মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।
এই ভাবে, ‘বাধাহীন’ ভাবনা নৈতিকতার নিরিখে জনগণের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও আদতে শর্তগুলির প্রকৃতি এবং তীব্রতা পার্থক্য করে দেয়। যেমনটা বলা হয়, সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চিন দ্বারা প্রদত্ত ত্রাণ মূলত কঠোর প্রবিধান-সহ এমন এক ধরনের ঋণ যার কোনও মকুব নেই। এবং যেমনটি দেখা গিয়েছে, প্রবিধানগুলি পূরণ না হলে প্রাপক দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কূটনীতির প্রতিযোগিতা
অঞ্চলটিকে তার সমস্ত প্রভাব-সহ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার অনেক আগে উন্নয়নমূলক সহযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসরে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এই অঞ্চলের নিরিখে প্রথম এবং প্রধান দাতা দেশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল জাপান। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রধান শক্তি। টোকিওর উন্নয়নমূলক সহায়তা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচির পাশাপাশি পরিবহণ ও জ্বালানি প্রকল্প-সহ পরিকাঠামো উন্নয়নের উপর মনোযোগ দিয়েছে। জাপান আসিয়ান এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের (এডিবি) মতো আঞ্চলিক সমন্বিতকরণ উদ্যোগেরও এক প্রধান সমর্থক। টোকিওর মতো ওয়াশিংটনও লোয়ার মেকং ইনিশিয়েটিভ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরের মতো আঞ্চলিক উদ্যোগকে সমর্থন করেছে। উন্নয়নমূলক সহায়তার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা-সহ আঞ্চলিক নিরাপত্তা উদ্যোগের প্রধান সমর্থক ছিল। প্যাসিফিক আইল্যান্ড ফোরামের মতো আঞ্চলিক সমন্বিতকরণ উদ্যোগের জন্য সমর্থনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সুশাসনের প্রচারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উন্নয়নমূলক সহায়তার আর একটি উল্লেখযোগ্য দাতা দেশ।
আধিপত্যের আখ্যান এই অঞ্চলটিকে এক দিকে পাশ্চাত্য দ্বারা চালিত ‘সমমনস্ক দেশ এবং অন্য দিকে চিন… এই দুইয়ের মাঝে বিভক্ত করেছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উন্নয়নমূলক সহযোগিতার প্রধান শক্তি হিসেবে চিনের দ্রুত এবং অপ্রতিরোধ্য উত্থানের কারণে উন্নয়নমূলক সহযোগিতার ‘প্রতিযোগিতা’ প্ররোচিত হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে বেজিংয়ের প্রবেশের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তার আগ্রাসী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রকৃতির কারণে যথেষ্ট পরিমাণে অস্পষ্টতা এবং আশঙ্কা বিদ্যমান। এই ভাবে বেজিংয়ের ত্রাণ সরবরাহের শর্তগুলি ইন্দো-প্যাসিফিকের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরকে বদলে দিয়েছে। আধিপত্যের আখ্যান এই অঞ্চলটিকে এক দিকে পাশ্চাত্য দ্বারা চালিত ‘সমমনস্ক দেশ এবং অন্য দিকে চিন… এই দুইয়ের মাঝে বিভক্ত করেছে। সহযোগিতামূলক পরিকাঠামো ও মঞ্চে অংশগ্রহণ করার সময়ে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশকে বেজিংয়ের রাগের কারণ না হওয়ার কথা মাথায় রেখে চলার নীতি অনুসরণ করতে হয়, যা আখেরে আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক আদেশের উপেক্ষার পাশাপাশি এই অঞ্চল জুড়ে চিনের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে জটিলতর করে তুলেছে। কারণ সমস্ত বৃহৎ শক্তির অর্থনৈতিক ভাগ্য ইন্দো-প্যাসিফিকের স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। যদিও একই সময়ে এটি রাজনৈতিক প্রণোদনা তৈরির সুযোগ করে দেয়, যা যে কোনও রকম অসম্মতি বা অবাধ্যতাকে প্রশ্রয় দেবে না। এমনটা অনুমান করা মূর্খামি হবে যে, লক্ষ্যগুলি সর্বদা পরার্থপর হবে। কারণ ভূ-রাজনৈতিক কারণগুলি সরকারের মিথস্ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই কারণে, উন্নয়নমূলক সহযোগিতা থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন না করার বিষয়টি উন্নয়নমূলক সহযোগিতার আলোচনা এবং অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে।
প্রত্নশ্রী বসু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিএনইডি প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.