Published on Jan 01, 2022 Updated 0 Hours ago

অনেক রাষ্ট্র বেজিংয়ে আসন্ন শীতকালীন অলিম্পিক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মঞ্চটিকে কি সংঘাত তৈরির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে?

২০২২ শীতকালীন অলিম্পিক: শীতল অভ্যর্থনা?

বেজিং-এ শীতকালীন অলিম্পিকের আর বেশি দেরি নেই। এদিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তবে কূটনৈতিক ভাবে। একটি সাংবাদিক বৈঠকে মার্কিন প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি জানিয়ে দিয়েছেন যে আনুষ্ঠানিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম দেশ যারা কূটনৈতিক পথে অলিম্পিক বয়কট করবে। তিনি বলেন, “জিনজিয়াং-এ পিআরসি (গণপ্রজাতন্ত্রী চিন)‌-র ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন কূটনৈতিক বা সরকারি প্রতিনিধিত্ব এই গেমস–কে সাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করবে।” পরবর্তী দিনগুলিতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও কানাডা তাদের মতো করে গেমস বয়কট করার কথা ঘোষণা করেছে।

১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও অন্য ৬৫টি দেশ ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক বয়কট করেছিল। আবার এর পাল্টা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ব্লকের ১৪টি দেশ ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক বয়কট করে নিজেরা ফ্রেন্ডশিপ গেমস আয়োজন করার পথ বেছে নেয়। তারপর, ১৯৮৮ সালের সোল অলিম্পিক উত্তর কোরিয়া ও অন্য পাঁচটি দেশ বয়কট করেছিল। বয়কটের এই ঐতিহ্য শেষ হয়েছিল ১৯৯২ সালে বার্সেলোনায়। অলিম্পিকস ওয়েবসাইটটি গর্বিত ভাবে জানিয়ে রেখেছে যে বার্সেলোনা হল ১৯৭২ সালের পর কোনও ধরনের বয়কট ব্যতিরেকে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম অলিম্পিক।

সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ব্লকের ১৪টি দেশ ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক বয়কট করে নিজেরা ফ্রেন্ডশিপ গেমস আয়োজন করার পথ বেছে নেয়।

এগুলি ছিল পুরোদস্তুর বয়কট, যেখানে এই দেশগুলির ক্রীড়াবিদরাও অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের ক্ষেত্রে তা ঘটছে না; এটি একটি কূটনৈতিক বয়কট, যা ক্রীড়াবিদদের তাদের নিজেদের দেশের পতাকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু তাঁদের তা করতে হবে নিজেদের দেশের উচ্চপদস্থ নেতা, সরকারি কর্মকর্তা বা কূটনীতিকদের অনুপস্থিতিতে। কাজেই এই বয়কট আগের মতো কড়া নয়। তাঁর ভাষণে প্রেস সেক্রেটারি সাকি বলেছিলেন যে গেমস–এর জন্য ক্রীড়াবিদদের বিনিয়োগের কথা মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বয়কট এড়ানো হয়েছে। হতে পারে এই দেশগুলোর এই ভাবে দু’‌কূল রাখার প্রয়াস দেশের ভেতরে জনপ্রিয়তা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গোল দেওয়ার চেষ্টা, কারণ এর ফলে পুরোদস্তুর বয়কটের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া এড়ানো গেল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীতকালীন অলিম্পিক বয়কট নিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি ঘোষণা করবে বলে মনে হচ্ছে। যদিও অনেক লিথুয়ানিয়ান রাজনৈতিক নেতা ও গোষ্ঠী ঘোষণা করেছে যে তারা গেমস–এ থাকবে না, কোনও রাষ্ট্রীয় অবস্থান কিন্তু এখনও ঘোষণা করা হয়নি, এবং সম্ভবত তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাকেই অনুসরণ করবে। তবে রাশিয়ান ফেডারেশন, ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের বিদেশমন্ত্রীদের ১৮তম বৈঠকে রুশ ও ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী, যথাক্রমে ল্যাভরভ ও জয়শঙ্কর, যে ভাবে সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন তার ভিত্তিতে ভারত-চিন সম্পর্কের একটি কঠিন বছরেও ভারত কূটনৈতিক ভাবে গেমস বয়কট করবে না বলে আশা করা হচ্ছে।

কোভিড-১৯ অতিমারি নিয়ে নীরবতা–সহ চিন গত এক বছরে অনেক ভাবে সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছে। এর ফলে নানা প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চিনের হিমশীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু, সব বয়কটের ডাকের প্রধান অভিমুখ হল চিনের মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা ২০২২ অলিম্পিকের আগে মানবাধিকার কর্মীরা বড় ভাবে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সেই সব ঘটনা যেগুলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বেশ কয়েকটি দেশ জিনজিয়াং প্রদেশে গণহত্যা এবং তাইওয়ান ও হংকংয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার উপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেছে।

যদিও অনেক লিথুয়ানিয়ান রাজনৈতিক নেতা ও গোষ্ঠী ঘোষণা করেছে যে তারা গেমস–এ থাকবে না, কোনও রাষ্ট্রীয় অবস্থান কিন্তু এখনও ঘোষণা করা হয়নি, এবং সম্ভবত তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাকেই অনুসরণ করবে।

শি জিনপিংয়ের অধীনে চিনের প্রাক্তন ভাইস-প্রিমিয়ার ঝাং গাওলির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনার পরে চিনা টেনিস তারকা পেং শুয়াই-এর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াকে ঘিরে যে প্রশ্নগুলো বার বার ফিরে আসছে, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে শেষতম উস্কানি। ওয়ার্ল্ড টেনিস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউটিএ) চিনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, উত্তর দাবি করেছে, এবং পরে চিন ও হংকংয়ের সমস্ত টুর্নামেন্ট স্থগিত করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়েছে, এবং তা শুধু তাদের প্রতিক্রিয়ার জন্য নয়, বরং তিন বারের অলিম্পিয়ানের অন্তর্ধানের পর তাদের যোগসাজসের জন্য। কারণ তারা বলেছিল ‘‌শান্ত কূটনীতি’‌ই হল সমাধানের শ্রেষ্ঠ পথ।

চিন দীর্ঘদিন ধরে অলিম্পিক আয়োজন করেছে, এবং সেই সঙ্গে ক্রীড়াক্ষেত্রে তার দক্ষতা বাড়িয়ে চলেছে, যা তার সফট পাওয়ার হিসেবে পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। চিন অতীতের নানা দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে, যেমন ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে হিটলারের আর্য জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার জন্য কুখ্যাত অস্ত্রায়ণ, আর ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে জাপানের প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বকে চমকে দেওয়া, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া পেছনে ফেলে দিল। সমসাময়িক চিন প্রতিটি অলিম্পিকে পদক তালিকার শীর্ষে থাকছে, এবং সেই সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অলিম্পিকে গৌরব অর্জনের জন্য অল্প বয়স থেকে ক্রীড়াবিদদের (যেমন পেং শুয়াই) প্রশিক্ষণ দেওয়া। চিন ২০০৮ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আয়োজন করেছিল, যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শিত হয়েছিল। বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে বলেছেন যে ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকে যদি এই বার্তা ঘোষিত হয়ে থাকে যে চিন ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত, তবে একই শহরে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজন করে—যা ইতিহাসে প্রথম বার ঘটল—চিন একথা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে তারা থাকার জন্যই এসেছে। চিনের জন্য ৮০টিরও বেশি রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের উপস্থিতি এমন একটি ছবি তুলে ধরবে যা চিনা রাষ্ট্রের বৈধতা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বৈদেশিক ক্ষেত্রে ও দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করা যাবে।

অলিম্পিকের উদ্দেশ্য হল সংঘাতকালেও একটা শান্তির সময় সৃষ্টি করা, যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ পরে পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি থাকবে।

তবে তা কী ভাবে গেমসের সময় এবং সামগ্রিক ভাবে চিনের ভাবমূর্তি তৈরিতে কাজে লাগবে? ২০১৮ পিয়ংচাং অলিম্পিকের মুখ্য ঘটনা ছিল দক্ষিণ কোরিয়া ও তার প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ, যেখানে উভয় দেশ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এক পতাকার (কোরিয়ার পুনর্মিলন পতাকা) নীচে হেঁটেছিল এবং একটি খেলাতে একটি দেশ হিসেবে খেলেছিল। দুই দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ায় উত্তর কোরিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব, যাঁদের মধ্যে ছিলেন কার্যকরীক্ষেত্রে প্রধান এবং প্রেসিডিয়াম চেয়ারম্যান কিম ইয়ং-নাম ও কিম ইয়ো-জং (কিম জং-উনের বোন)। সফট পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত থেকে গেমস হয়ে ওঠে খেলোয়াড়ি মনোভাবে বিজড়িত হওয়ার একটি পরোক্ষ শীর্ষ পর্যায়। যে হেতু সেখানে সমাধানের জন্য কোনও চাপ নেই, এবং স্পটলাইটও রাজনীতিবিদদের উপর নেই, তাই এটি প্রায়শই সংলাপ ও যোগাযোগের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। অলিম্পিকের উদ্দেশ্য হল সংঘাতকালেও একটা শান্তির সময় সৃষ্টি করা, যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ পরে পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি থাকবে।

কিন্তু বয়কটের ঘোষণা কি খেলোয়াড়–সুলভ পদ্ধতিতে মেনে নেওয়া হচ্ছে? মার্কিন ঘোষণার আগে বিদেশ বিষয়ক চিনা মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছিলেন, ‘‌আমন্ত্রণ পাওয়ার আগেই মার্কিন রাজনীতিবিদরা বেজিং শীতকালীন অলিম্পিকের তথাকথিত কূটনৈতিক বয়কটের কথা বুক বাজিয়ে প্রচার করে চলেছেন, যা সম্পূর্ণরূপে কল্পনাপ্রসূত চিন্তাভাবনা এবং বাহবা পাওয়ার উদ্দেশ্যে বড় বড় কথা বলা ।’‌ ঘোষণার পরে তিনি বলেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এর জন্য ‘‌মূল্য দিতে হবে’‌। আইওসি কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বয়কট মেনে নিয়ে বলেছে, “সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিকেরা উপস্থিত থাকবেন কি না তা প্রতিটি সরকারের একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ আইওসি সম্পূর্ণ ভাবে সম্মান করে।

২০২২ অলিম্পিকের সফট পাওয়ার গেমস–এর বিজয়ী কে, তা নির্ভর করবে অলিম্পিক বয়কটকারী দেশের সংখ্যা এবং তাদের বয়কটের গভীরতার উপর। যদি এই দেশগুলো তাদের প্রয়াসের পর সংখ্যালঘু থেকে যায়, তবে তা চিনের পক্ষে যাবে এবং বিশ্বব্যাপী সমর্থনভিত্তি তৈরির জন্য তার প্রচেষ্টার সহায়ক হবে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.