চিনের সঙ্গে মধুযাপন শেষ হলেও অ্যাঙ্গোলার সমস্যার কি অবসান হবে?
দক্ষিণ আফ্রিকার খনিজসমৃদ্ধ দেশ অ্যাঙ্গোলা ‘রিসোর্স কার্স’ বা ‘সম্পদ অভিশাপ’-এর একটি আদর্শ উদাহরণ। দেশটিকে প্রায়শই ‘বিশ্বের ধনীতম দরিদ্র দেশ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কারণ তার খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য দেশের জনসাধারণের তীব্র দারিদ্র দূরীকরণের কাজে লাগানো সম্ভবপর হয়নি। সে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯.৯ শতাংশ মানুষ আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন, যাঁদের মাথাপিছু দৈনিক উপার্জন ১.৯০ মার্কিন ডলারেরও কম। ‘সম্পদ অভিশাপ’ বা ‘প্রাচুর্যের সমস্যা’ এই সত্যিই তুলে ধরে যে, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির কারণে বেশির ভাগ সম্পদশালী দরিদ্র দেশগুলি সাধারণত দুর্নীতি, সংঘাত এবং সম্পদের প্রাচুর্যের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার শিকার হয়। অ্যাঙ্গোলা যথার্থই এই জালে জড়িয়ে। গৃহযুদ্ধের বছরগুলিতে এম পি এল এ (মার্কসিস্ট পপুলার মুভমেন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ অ্যাঙ্গোলা) এবং ইউ এন আই টি এ-র (ন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য টোটাল ইনডিপেনডেন্স অফ অ্যাঙ্গোলা) মতো দু’টি যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রাপ্ত অর্থ বা রিসোর্স রেন্ট ব্যবহার করেছিল। এম পি এল এ যখন এক দিকে অ্যাঙ্গোলার তেলের রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ করত, তখন অন্য দিকে ইউ এন আই টি এ অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে দেশের হিরের ভাণ্ডারে আধিপত্য চালাত। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে এম পি এল এ সরকার চিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তেল রফতানির পরিমাণও নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০০২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশটি উচ্চ হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মুখ দেখলেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফলগুলি প্রধানত প্রেসিডেন্ট ডস সান্তোস এবং তাঁর পরিবারের নেতৃত্বে অ্যাঙ্গোলান অভিজাতরাই ভোগ করেছিল। দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ মানুষই অ্যাঙ্গোলার উন্নতির আঁচটুকু পায়নি। অ্যাঙ্গোলার অর্থনীতি বর্তমানে গভীর অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোয়াও লোরেনসো প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি, দুর্নীতি দমন এবং চিন ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি কি দেশের দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারবেন?
অ্যাঙ্গোলার অর্থনীতি বর্তমানে গভীর অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোয়াও লোরেনসো প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি, দুর্নীতি দমন এবং চিন ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি কি দেশের দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারবেন?
গৃহযুদ্ধোত্তর পর্বে চিন-অ্যাঙ্গোলা সম্পর্ক
চিন-অ্যাঙ্গোলা সম্পর্ক ২০০০-এর দশকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিল এবং কিছু দিন আগে পর্যন্তও দেশটিকে আফ্রিকায় চিনা প্রভাবসম্পন্ন দেশগুলির ‘পোস্টার চাইল্ড’ বা আদর্শতম উদাহরণ হিসেবে দেখা হত। ২০০২ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অ্যাঙ্গোলার সরকার দেশটির পুনর্গঠনের জন্য তহবিল নির্মাণের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যদিও আই এম এফ-এর সঙ্গে সরকারের আলোচনা ব্যর্থ হয়। কারণ অ্যাঙ্গোলার সরকার আই এম এফ-এর দারিদ্র্য হ্রাস কৌশল পরিকল্পনা বা পভার্টি রিডাকশন স্ট্র্যাটেজি প্ল্যানস (পি আর এস পি) এবং স্টাফ মনিটরড প্রোগ্রামের (এস এম পি) সঙ্গে সম্মত হয়নি। অন্য দিকে চিন কোনও পূর্বশর্ত ছাড়াই দেশটির পুনর্গঠনের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ ঋণ দিতে রাজি হয়। এর ফল স্বরূপ, অ্যাঙ্গোলার সরকার চিনের মুখাপেক্ষী হয় এবং ২০০৩ সালে চুক্তির জন্য ফ্রেমওয়ার্ক স্বাক্ষর করে। চিন ২০০৪ সালে লাইবর প্লাসের আওতায় ১.৫ শতাংশ ছাড়ের সুদের হারে সরকারি পরিকাঠামো প্রকল্পের জন্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রাথমিক ঋণ প্রদান করে। এটি অ্যাঙ্গোলাকে তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ড-সহ ১২ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। অ্যাঙ্গোলা সরকার চিনকে প্রতি দিন ১০,০০০ ব্যারেল তেল দিতে সম্মত হয়। পরবর্তী কালে চিনের এক্সিম ব্যাঙ্ক অ্যাঙ্গোলায় এই ধরনের তেলের বিনিময়ে বেশ কয়েকটি ঋণ প্রদানের পথ খুলে দেয়। বেশির ভাগ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অ্যাঙ্গোলা চিনা পরিকাঠামোর শীর্ষ প্রাপক এবং চিন এখন পর্যন্ত দেশটিকে ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করেছে। চিন-অ্যাঙ্গোলা চুক্তি সংক্রান্ত অস্বচ্ছতার পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রকৃত পরিসংখ্যান আরও বেশি হতে পারে।
উচ্চ দ্রব্যমূল্য এবং তেল উৎপাদনে দ্রুত বৃদ্ধির কারণে অ্যাঙ্গোলা ২০০২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উচ্চ হারের মুখ দেখে। চিন দ্রুত অ্যাঙ্গোলার শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ২০১৩ সালের মধ্যে অ্যাঙ্গোলার তেলের প্রায় ৪৫ শতাংশ আমদানিকারক দেশ হয়ে ওঠে চিন। অ্যাঙ্গোলা চিনা তহবিলের মাধ্যমে নিজেদের পরিকাঠামো শৃঙ্খল পুনর্গঠনের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। যদিও চিনা ঋণ বর্তমানে অ্যাঙ্গোলায় একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
গোলমালটা ঠিক কোথায়?
প্রথমত, চিনা ঋণ চিনা সংস্থা এবং পণ্য ব্যবহারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। প্রেসিডেন্ট ডস সান্তোসের নেতৃত্বে অ্যাঙ্গোলা সরকার অ্যাঙ্গোলায় চিনা সংস্থাগুলিকে সাহায্য করার জন্য দেশের স্থানীয় পণ্য নীতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেন। ফলে এই ধরনের প্রকল্প স্থানীয় জনসাধারণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, চিনা পরিকাঠামো প্রকল্পগুলি অবশেষে দুর্নীতি এবং দুর্বল প্রশাসনের সঙ্গে সমার্থক হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট চিনা প্রকল্পগুলি পরিচালনা করার জন্য জি আর এন-এর মতো সমান্তরাল সরকারের প্রবর্তন করেছিলেন যা শুধু মাত্র তাঁর কাছেই দায়বদ্ধ ছিল। এক দিকে প্রেসিডেন্টের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং চিনা ঋণের ব্যবস্থাপনায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন তাঁর ঘনিষ্ঠ আধিকারিকরা এর সম্পূর্ণ মুনাফা তুলতে থাকেন, এবং অন্য দিকে সাধারণ অ্যাঙ্গোলান নাগরিক যৎকিঞ্চিৎ লাভবান হন। অ্যাঙ্গোলার সাংবাদিক রাফায়েল মার্কেস দেমোরাইস অ্যাঙ্গোলার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে ‘দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু’ বলে অভিহিত করেছেন। তৃতীয়ত, তেলের দামের পতন এবং তেল উৎপাদন হ্রাস তেল-সমর্থিত ঋণগুলিকে অ-স্থিতিশীল করে তুলেছে এবং অ্যাঙ্গোলার অর্থনীতিকে তীব্র ভাবে আঘাত করেছে। কারণ চিনের ব্যাঙ্কগুলির ঋণ পরিশোধের পর, এবং তা-ও অত্যন্ত নিম্ন মূল্যে, আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করার জন্য দেশটির কাছে খুব সামান্যই তেল রয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই চিন ও অ্যাঙ্গোলার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। অ্যাঙ্গোলা সরকার যখন চিনা ঋণকে অস্থিতিশীল বলে মনে করছে, তখন চিন মনে করছে, অ্যাঙ্গোলায় তারা অতিরিক্ত মাত্রায় বিনিয়োগ করেছে।
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ডস সান্তোসের প্রস্থানের পর তাঁর উত্তরসূরি জোয়াও লোরেনসো প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি দুর্নীতি দমনের চেষ্টা করেছেন। ডস সান্তোস প্রশাসনের অধীনে চিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলির সম্পর্কে লোরেনসো তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে স্বাক্ষরিত বেশ কিছু চুক্তি বাতিল করে দেন। এর পাশাপাশি পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত মুখ্য আধিকারিকদের তিনি গ্রেফতার করেন এবং চিন ব্যতীত অন্য অংশীদার দেশগুলির সন্ধানে লেগে পড়েন।
সামনের পথ
স্বাভাবিক ভাবেই চিন ও অ্যাঙ্গোলার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। অ্যাঙ্গোলা সরকার যখন চিনা ঋণকে অস্থিতিশীল বলে মনে করছে, তখন চিন মনে করছে, অ্যাঙ্গোলায় তারা অতিরিক্ত মাত্রায় বিনিয়োগ করেছে। চিনা প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতিও চিনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। এর পাশাপাশি, প্রধানত পশ্চিমি সংস্থাগুলির আধিপত্য থাকার কারণে অ্যাঙ্গোলান তেলের বাজারে চিন কখনওই সুবিধে করে উঠতে পারেনি। কারভালহো, কোপিনস্কি এবং টেলরের মতো একাধিক গবেষক উল্লেখ করেছেন যে, বিদেশি অংশীদার দেশগুলির বৈচিত্রকরণের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা অ্যাঙ্গোলার বৈদেশিক নীতির একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু পূর্ববর্তী শাসনকালে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল বা সেই সংক্রান্ত পুনরায় আলোচনা অথবা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী সরকারের অনুগ্রহপ্রাপ্ত দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকদের শাস্তি প্রদান শাসন ব্যবস্থায় স্থায়ী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে না। আসল প্রশ্ন হল, অ্যাঙ্গোলা কি তার অতীতের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের আরও ভাল ভাবে ব্যবস্থাপনা করতে এবং আগামী বছরগুলিতে তার অর্থনীতির বৈচিত্রকরণে সক্ষম হতে পারবে? যে সব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল, সে সব দেশ মৌলিক ভাবে ভঙ্গুরও। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পল কোলিয়ার জোর দিয়ে বলেছেন যে, দেশগুলির উচিত নিজেদের অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা এবং তাদের সম্পদের আরও উন্নততর ব্যবস্থাপনা করতে শিখতে পারা। তিনি মালয়েশিয়া এবং বতসোয়ানার উদাহরণ দিয়েছেন, যারা প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব উৎপাদন শিল্পে সফলভাবে বিনিয়োগ করতে পেরেছে। অ্যাঙ্গোলাতেও এমনটা করতে পারা বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। বিরোধীদের শাস্তি দেওয়া এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের পরিবার ও সহযোগীদের গ্রেফতার করা সহজ হলেও স্বচ্ছ সরকার পরিচালনা করা বেশ কঠিন। লোরেনসোর সরকারও দুর্নীতির কেলেঙ্কারি থেকে মুক্ত নয়। সম্প্রতি অ্যাঙ্গোলার পরিবহণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর বন্ধু রুই অস্কার ফেরেরা সান্তোস ভ্যান ডুনেমকে ৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি চুক্তি সংক্রান্ত স্বজনপোষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশটি এখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছে। নতুন সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারগুলির মধ্যে বিশেষ করে সম্পদ ক্ষেত্র এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণের নিরিখে প্রশাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা অন্যতম হওয়া উচিত।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.