ভারতের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি একটি অন্যতম প্রাপ্তি ছিল মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতকে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য একটি রেল ও শিপিং করিডোর তৈরির নতুন উদ্যোগ। হোয়াইট হাউসের একটি ফ্যাক্টশিট অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা একটি নতুন ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোর (আইএমইসি) প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়ে একটি সমঝোতাপত্র (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছেন।
সৌদি আরব, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং জর্ডন-সহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু প্রধান দেশ এটির অংশ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই করিডোরকে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে। পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (পিজিআইআই) সংক্রান্ত জি-২০ নেতাদের সভায় এই করিডোরের কথা ঘোষণা করে নেতারা উল্লেখ করেছেন যে, আইএমইসি রেল সংযোগ, শিপিং লাইন, উচ্চ গতিসম্পন্ন ডেটা কেবল এবং জ্বালানির পাইপলাইনগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করবে। এগুলি বিদ্যমান সামুদ্রিক ও সড়ক শৃঙ্খলগুলির পরিপূরক হয়ে উঠবে, যা ‘ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, জর্ডন, ইজরায়েল এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য ও পরিষেবার আদান-প্রদান উন্নত করবে।’
বিশেষ করে চিন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চালু করার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদাররা কার্যকর বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়েছে। ২০২২ সালের অগস্ট মাসে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে চিনের বিআরআই-এর বিকল্প হিসাবে পিজিআইআই চালু করা হয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সংযোগ প্রকল্পে অর্থায়নের উদ্দেশ্যে একটি অবকাঠামোমূলক উদ্যোগ। আইএমইসি-র মতো, পিজিআইআই-এর মনোনিবেশের চারটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে: স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, ডিজিটাল সংযোগ, লিঙ্গ সমতা ও সাম্য এবং জলবায়ু ও জ্বালানি নিরাপত্তা। এক বছর পরে মউ স্বাক্ষরিত হলে পিজিআইআই-এর একগুচ্ছ প্রকল্প এবং বিনিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আইএমইসি-র পাশাপাশি জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘ট্রান্স-আফ্রিকান করিডোর’-এর পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করে, যা অ্যাঙ্গোলা, জাম্বিয়া এবং কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে সংযুক্তকারী একটি পরিবহণ শৃঙ্খল। সাংবাদিক বিজ্ঞপ্তিতে ট্রান্স-আফ্রিকান করিডোরকে পিজিআইআই-এর ‘একটি শক্তিশালী বিবর্তন’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
আইএমইসি একটি অবকাঠামো এবং সংযোগের দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রকল্পে দু’টি পৃথক করিডোর জড়িত -- পূর্ব করিডোর, যা ভারতকে আরব উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং উত্তর করিডোর, যা আরব উপসাগরকে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করে। মউ অনুসারে, আইএমইসি ‘এশিয়া, আরব উপসাগর এবং ইউরোপের মধ্যে বর্ধিত সংযোগ ও অর্থনৈতিক সমন্বিতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চালিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
নতুন করিডোরটির নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খল, উন্নততর বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার ও সুবিধা-সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা রয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলি ‘দক্ষতা বৃদ্ধি করতে, খরচ কমাতে, অর্থনৈতিক ঐক্য বাড়াতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে আগ্রহী, যার ফলে এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের একটি রূপান্তরমূলক সমন্বিতকরণ সম্ভব।’
বিশদ বিবরণ প্রকাশ্যে না এলেও বর্তমানে যা জানা যায় তা হল, আইএমইসি ইজরায়েলের হাইফা, গ্রিসের পাইরাস এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলে মুন্দ্রা (গুজরাত), কান্ডলা (গুজরাত) এবং জওহরলাল নেহরু পোর্ট ট্রাস্টের (নভি মুম্বই) মতো তিনটি বন্দর-সহ বেশ কয়েকটি বন্দরকে সংযুক্ত করার জন্য বিভিন্ন পথ খতিয়ে দেখছে। মধ্যপ্রাচ্যে পাঁচটি বন্দর রয়েছে যা ভারতীয় বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত হবে এবং এর অন্যতম হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ফুজাইরা, জেবেল আলি ও আবু ধাবির পাশাপাশি সৌদি আরবের দাম্মাম ও রাস আল খায়ের বন্দর। এগুলিকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেই পথের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হবে যেগুলি ‘একটি পথে মালবাহী ভার কমিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে।’
এ কথা উল্লেখ্য যে ভারতের মুন্দ্রা বন্দর, ইজরায়েলের হাইফা বন্দর এবং গ্রিসের পাইরাস বন্দর ছাড়া সব বন্দরই সরকারি মালিকানাধীন। মুন্দ্রা ও হাইফা বন্দর ভারতীয় সংস্থা আদানি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গ্রিসের পাইরাস বন্দর কসকো শিপিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যা চিনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি সংস্থা এবং সেটি ২০১৬ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদারিত্ব অর্জন করেছিল।
গণমাধ্যমে উদ্ধৃত সরকারি তথ্য অনুসারে, মধ্যপ্রাচ্যের অবকাঠামো, বিশেষ করে রেলওয়ে শৃঙ্খলের অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য গবেষণা চালানো হচ্ছে। আইএমইসি-র অধীনে নতুন নির্মাণ কাজের জন্য নানাবিধ ঘাটতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইএমইসি-র প্রস্তাবিত খরচ উপলব্ধ না হলেও একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, অংশীদার দেশগুলি অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য ‘আনুমানিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করতে পারে।’ অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি আইএমইসি রুট গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক ভাবে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমান করা হয়েছে। যদিও আধিকারিকরা বলেছেন যে, ‘নিখুঁত খরচ বলা সম্ভব নয়।’
যে দেশগুলি এই সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছে, তারা নভেম্বর মাসে বিশদ বিবরণ তৈরির উদ্দেশ্যে বৈঠকে বসেছে।
ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আইএমইসি-কে চিনের বিআরআই-এর বিকল্প হিসেবে মনে করা হলেও বিআরআই-এর সম্ভাবনা ও পরিসর অনেক বেশি। এক দশক আগে চালু হওয়ার পর থেকে ১৫০টিরও বেশি দেশ এবং প্রায় ৩০টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিআরআই-তে স্বাক্ষর করেছে। ভারত প্রথম দিন থেকেই এই প্রকল্পে আপত্তি জানিয়েছে। কারণ বিআরআই-এর একটি মূল উপাদান চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর ভারতের দাবিকৃত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলে। বিপুল সংখ্যক দেশ বিআরআই-কে সমর্থন করলেও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে ঋণের সমস্যায় বিআরআই-এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অতি সম্প্রতি ইতালি বিআরআই থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। কারণ এটি ‘প্রত্যাশিত ফলাফল প্রদান করতে পারেনি।’
বিআরআই-এর মতো উদ্যোগের মাধ্যমে চিন যে ধরনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রসার ঘটিয়েছে, তা কোনও একটি দেশের জন্য দুরূহ। যাই হোক, এ কথা উল্লেখ্য যে, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক ভাবে সক্ষম দেশগুলি সম্মিলিত ভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে একটি কার্যকর বিকল্পের প্রস্তাব দিয়ে চিনের প্রচেষ্টাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আইএমইসি অংশীদার দেশগুলির কাছে সম্ভবত সেই সব উপকরণই রয়েছে, যা বেজিংয়ের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.