চিন-জাপান-কোরিয়া (সিজেকে) ত্রিপাক্ষিক জোটের বৈঠক পুনরায় শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক আশাবাদও নজরে এসেছে। ১৯৯৯ সালে ম্যানিলায় আসিয়ান প্লাস থ্রি (এপিটি) বৈঠকের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ক একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হিসাবে প্রথম উত্থাপিত তিনটি দেশের মধ্যে এই সহযোগিতামূলক আলোচনাকে যথেষ্ট সন্দেহের সঙ্গেই বিচার করা হত। কিন্তু ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে মেধা সম্পত্তির অধিকার, সম্পদ সংরক্ষণ, নিরাপত্তা অপরিহার্যতা এবং উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মতো ক্ষেত্রগুলিকে কেন্দ্র করে একটি ‘অ্যাকশন স্ট্র্যাটেজি’র সূচনা হয়েছিল। ২০০৮ সালে, বেশ বড় বাধা কাটিয়ে ওঠার পরে জাপানের ফুকুওকাতে প্রথম স্বাধীন ত্রিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলন একটি সন্ধিক্ষণের ইঙ্গিত দেয় এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিওলে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা সচিবালয় বা ট্রাইল্যাটেরাল কোঅপারেশন সেক্রেটারিয়েট খোলা হয়। টানাপড়েনময় দ্বিপাক্ষিক পরিস্থিতি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকগুলিকে প্রভাবিত করলেও নিম্ন স্তরে (এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অরাজনৈতিক) আলোচনাগুলি কার্যকর ছিল, বিশেষ করে অর্থ, বিজ্ঞান ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে। এই সময়ই ২০১১ সালে জাপানের ভূমিকম্প এবং ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয়ের পরবর্তী সময়ে প্রথম বারের মতো ২০১৩ সালে ট্রাইল্যাটেরাল টেবলটপ এক্সারসাইজ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে যৌথ প্রতিক্রিয়ার নিরিখে এক উল্লেখযোগ্য পরিচালক পরিকাঠামো হয়ে ওঠে।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে টোকিয়ো এবং সোল উভয়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি এবং ২০২৩ সালের আগে তিনটি দেশের মধ্যে প্রথম ত্রিপাক্ষিক বৈঠক দর্শায় যে, তিনটি দেশই এই অঞ্চলের সমীকরণকে ধীরে ধীরে অথচ অবিচলিত ভাবে পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তুত।
উত্তর-পূর্ব এশীয় ভূ-রাজনীতিতে সাম্প্রতিক পরিবর্তন বেজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই অনুকূল নয়। ওয়াশিংটনের সঙ্গে টোকিয়ো এবং সোল উভয়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি এবং ২০২৩ সালের আগে তিনটি দেশের মধ্যে প্রথম ত্রিপাক্ষিক বৈঠক দর্শায় যে, তিনটি দেশই এই অঞ্চলের সমীকরণকে ধীরে ধীরে অথচ অবিচলিত ভাবে পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তুত। সোল এবং টোকিয়োকে ওয়াশিংটনের প্রভাব বলয় থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা বেজিংয়ের তরফে প্রত্যাশিত। এ রকম একটি উপায় হল সিজেকে ত্রিপাক্ষিক ফোরাম। তা সত্ত্বেও চিন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে ত্রিপাক্ষিকতার পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে জল্পনার জন্ম হলেও বৈঠকটি কী ভাবে শেষ হয়েছে, তা অন্তত অদূর ভবিষ্যতে গোষ্ঠীটির সম্মুখে এক নিদর্শন রাখবে।
জাপান চিনের শীর্ষ পাঁচটি বিদেশি বিনিয়োগকারীর অন্যতম এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান চিনা পণ্য ও পরিষেবার নিরিখে সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। একটি ত্রিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক তখনই বিকশিত হয় যখন চিন জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করে চূড়ান্ত পণ্যগুলিতে প্রক্রিয়াকরণ ও অন্য এশীয় দেশগুলির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কাজটি করে। এক দশক আগে হওয়া একটি আন্তঃ-সিজেকে বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব এশিয়ায় বহুপাক্ষিক অঞ্চলব্যাপী এফটিএ-র নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, যা এশিয়ার বাজারের গভীর সমন্বিতকরণের দিকে চালিত করে, এমনকি অভিন্ন সাধারণ সরবরাহ শৃঙ্খল, উৎপাদন শৃঙ্খল, বাণিজ্যে অশুল্ক, প্রযুক্তিগত বাধাগুলির বিধানও প্রদান করে। বেজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে, কোরিয়ার সঙ্গে ইতিমধ্যে বিদ্যমান ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব (২০১০ সাল থেকে) এবং জাপানের সঙ্গে অনুরূপ চুক্তি (২০১১ সাল থেকে) দ্বারা প্রদত্ত প্রণোদনার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক স্তরে চিনের সঙ্গে অনুরূপ অংশীদারিত্ব বিদ্যমান পার্থক্যের সমাধান ঘটানোর পাশাপাশি একটি বহুপাক্ষিক সহযোগিতা শৃঙ্খলের পথও প্রশস্ত করবে।
এক দশক আগে হওয়া একটি আন্তঃ-সিজেকে বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব এশিয়ায় বহুপাক্ষিক অঞ্চলব্যাপী এফটিএ-র নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, যা এশিয়ার বাজারের গভীর সমন্বিতকরণের দিকে চালিত করে, এমনকি অভিন্ন সাধারণ সরবরাহ শৃঙ্খল, উৎপাদন শৃঙ্খল, বাণিজ্যে অশুল্ক, প্রযুক্তিগত বাধাগুলির বিধানও প্রদান করে।
বুসান শীর্ষ সিজেকে কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক আহ্বায়ক হওয়ায় নানাবিধ অনুমানের আলোড়ন উঠেছিল। টোকিয়োর ফুকুশিমা থেকে প্রক্রিয়াজাত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য জলের বিতর্কিত নিষ্কাশনের ফলে জাপানি সামুদ্রিক খাবারের উপর চিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য জাপানের দাবি প্রকাশ্যে আসে। জাপানের পক্ষ থেকে ‘দায়িত্বহীন আচরণ’-এর বিরুদ্ধে ওয়াং ই-এর প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত এক বাদানুবাদের সূত্রপাত ঘটায়। তিনি প্রক্রিয়াটির একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণের জন্য দাবি জানিয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার উস্কানি রোধে চিনা প্রচেষ্টার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায়, চিন নিজেকে এই অঞ্চলে একটি ‘স্থিতিশীল শক্তি’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতের গঠনমূলক সম্পর্কের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে চিন তার ভূমিকা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং আহ্বান জানিয়েছে যে, ‘এক চিন’ নীতি বজায় রাখতে হবে। তবে, গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমন্বিতকরণের গতি বজায় রাখার উপর চাপ-সহ উদ্ভাবন, অগ্রগতি এবং পারস্পরিক সুবিধার সম্পর্কের জন্য তিনটি দেশের মধ্যকার সমীকরণকে আরও নিবিড় করে তোলা যথেষ্ট চাপের কাজ ছিল। তিন বিদেশমন্ত্রী নিরাপত্তা, পরিবেশ, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন। তাঁরা পিয়ংইয়ং পারমাণবিক কর্মসূচির হুমকির কথাও বলেছে্ন।
সম্ভবত একটি ত্রিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলন ইতিবাচক হতে পারে এবং পরের বছরের শুরুর দিকে একটি বৈঠকে ত্রিপাক্ষিক এফটিএ আলোচনা পুনরায় চালু করার পাশাপাশি ত্রিমুখী সহযোগিতার কৌশল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। যাই হোক, ২০১৯ সালের পর থেকে প্রথম বারের মতো এই একটি ত্রিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের কথা আলোচিত হলেও কখন অনুষ্ঠিত হতে পারে সে সম্পর্কে তেমন তথ্য মেলেনি। নভেম্বর মাসে বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকের কথা মাথায় রাখলে দু’টি প্রধান কারণে সিজেকে ত্রিপাক্ষিক গঠনমূলক আলোচনার সম্ভাবনা নেহাতই কম। প্রথমত, বেজিং পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ক্রমাগত জোরদার করে চলেছে। এর সাম্প্রতিকতমটি ঘটেছে তিন বিদেশমন্ত্রীর সমাবেশের কাছাকাছি সময়েই। এবং দ্বিতীয়ত, সোল এবং টোকিয়োকে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে সরিয়ে আনার বেজিংয়ের প্রচেষ্টা অপ্রতুলই ছিল। চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই তাঁর জাপানি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সমকক্ষের সঙ্গে দেখা করার আগে তিনজনই একত্রে মিলিত হন এবং প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় ‘আন্তরিকতা’ নিয়ে জোটে আসার উপর জোর দেন। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চিনের বার্তাপ্রেরণের মূল বিষয় এবং তিনটি দেশের মধ্যে একটি দেশের মূল বিষয়টি ছিল এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে বহিরাগত এবং জাপান ও কোরিয়ার উচিত চিনের পক্ষাবলম্বন করা। আপাতত তাই সিজেকে ত্রিপাক্ষিক জোটের ভবিষ্যৎ মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।
প্রত্নশ্রী বসু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
ঐশিকী চৌধুরী অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিসার্চ ইন্টার্ন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.