Author : Harsh V. Pant

Published on Sep 07, 2021 Updated 0 Hours ago

সংস্কারের ফলে ভারতে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে এবং তাই আগে যে ভাবে ভারত বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হত সেই ধারাটি বদলে যায়।

অর্থনৈতিক সংস্কার কী ভাবে ভারতের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করল

এই নিবন্ধটি ৩০ বছর পরে: সংস্কার কর্মসূচির পর্যালোচনা ও পুনর্নবীকরণ নামক একটি সিরিজের অংশ।


একটি রাষ্ট্র তার বৈদেশিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতির মাপকাঠি বদলাতে দীর্ঘ সময় নেয়। তার কারণ একটি দেশের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের অনেকগুলি উৎস থাকে: আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ঘরোয়া রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণসমূহ, এবং সিদ্ধান্ত-গ্রহীতাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও উপলব্ধি। সাধারণত এর ফলে একটি দেশের বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত কাঠামোয় একটি আবশ্যিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। অন্যান্য অধিকাংশ রাষ্ট্রের মতোই ভারতের বৈদেশিক নীতিও ঐতিহ্যগত ভাবে এই সব বিবিধ কারণ ও তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া এবং একে অপরকে প্রভাবিত করার উপর নির্ভরশীল।

আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারতের উত্থান একটা বাস্তব ঘটনা, আর তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তির মধ্যে দিয়ে।

তা সত্ত্বেও একেকটা সময় আসে যখন কোনও রাষ্ট্র এমন একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়ায় যেখানে তার লক্ষ্য, পথ ও উপায়, এই ত্রয়ীকে নতুন করে সাজাতে হয়, এবং সেটাও করতে হয় একটা বড়সড় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। এই ধরনের নির্ণায়ক সন্ধিকাল বিরল, কিন্তু যখন তেমন সময় আসে তখন রাষ্ট্রকেও নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখন যখন ভারত ১৯৯১ সালের সংস্কারের ৩০তম বার্ষিকী উদযাপন করছে, তখন গত তিন দশকে দেশের বৈদেশিক নীতির গতিপথ স্থির করে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সংস্কারের কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা বিবেচনা করার, এবং তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে। ভারতের নীতি নির্ধারকরা নিজেদের দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদেশনীতি পুনর্গঠিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশ্বশক্তিগুলির ভারসাম্যের নিরিখে যখন একটা দেশের গুরুত্ব বাড়তে থাকে তখন সেই দেশের সামনে চলে আসে এক বড়সড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়– সে কি বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরবে বিশ্বের দরবারে? অবশ্য একটা রাষ্ট্রের ওই ধরনের মর্যাদা গ্রহণ করা বা না–করার স্বাধীনতা কিন্তু বাস্তবে অনেকটা সীমিত হয়ে যায় অনেকগুলি কাঠামোগত নির্ধারকের কারণে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারতের উত্থান একটা বাস্তব ঘটনা, আর তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তির মধ্যে দিয়ে।

ঠান্ডা লড়াই এর পুরো সময়টায় দুই মহাশক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধ থেকে নিজেকে কী ভাবে সরিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে ভারত যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে থাকত। তখন নির্জোট (নন–অ্যালাইন্ড) বৈদেশিক নীতি নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ছিল, কারণ অন্তত তত্ত্বগত ভাবে তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সিদ্ধান্তগ্রহণ সংক্রান্ত স্বাধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। তৃতীয় বিশ্বের ঐক্য নিয়ে তথাকথিত বাগাড়ম্বরের পেছনে কিন্তু ছিল দেশের নিজস্ব স্বার্থগুলো রক্ষার একটা ঠান্ডা মাথার ভাবনাচিন্তা। তবে তখন সেই স্বার্থসমূহের পরিসর সীমিত ছিল, কারণ ভারতের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাও তুলনামূলক ভাবে কম ছিল। ভারতের কাছে সব থেকে বড় বিপদ ছিল পাকিস্তানের নিরাপত্তা কৌশল। সেই সময়ে ভারতের পাকিস্তান নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে থাকাটা বিস্ময়কর ছিল না।

তৃতীয় বিশ্বের ঐক্য নিয়ে তথাকথিত বাগাড়ম্বরের পেছনে ছিল দেশের নিজস্ব স্বার্থগুলো রক্ষার একটা ঠান্ডা মাথার ভাবনাচিন্তা।

কিন্তু পাকিস্তান বাদে বাকি বিশ্ব নিয়ে মোটেই যথেষ্ট স্বচ্ছতা ছিল না, আর তা একেবারে প্রকাশ্যে চলে এল ১৯৬২ সালে চিনের হাতে ভারতের অত্যন্ত হতাশাজনক পরাজয়ের সময়। এমনকি পাকিস্তান সম্পর্কেও যে ভারতের কোনও সুসংহত কৌশল ছিল, তা মনে করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধ হয়েছে আর ভারত সেই যুদ্ধগুলো লড়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধগুলো থেকে বেরিয়ে আসার মতো কোনও নীতি নেওয়ার কথা কখনও ভাবেনি। ভারত কখনও নিজে যুদ্ধ শুরু করেনি, শুধু যখন প্ররোচিত হয়েছে তখনই লড়তে নেমেছে বলে পিঠ চাপড়ানি কিন্তু এই সত্যটাকে গোপন করতে পারে না যে ভারতের বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতির কেন্দ্রস্থলে একটা বিশাল শূন্যতা থেকে গেছিল।

ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর বৈদেশিক নীতি

ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঘটনাটা ছিল একটা ছদ্মবেশী আশীর্বাদ। কারণ তা ছিল একটা অবশ্য প্রয়োজনীয় ধাক্কা, যা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বাধ্য করল নতুন বিশ্বজনীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রীয় ধারণাগুলিকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে হল। পৃথিবীর চেহারা বদলে গেল, আর তা বুঝিয়ে দিল ভারতের নতুন বৈদেশিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতি নেওয়ার সম্ভাবনার পথ খুলে গেছে।

ভারতের অর্থনীতি খুবই ভাল ফল করতে শুরু করার পর ভারতের গণতন্ত্রও অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল।

এই সময় ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার দেশকে উচ্চতর বৃদ্ধির রাস্তায় পৌঁছে দিল, আর তার ফলে মহাশক্তি–রাজনীতির মধ্যে তাকে ঢুকতেই হল। আর নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় যখন নতুন দশক শুরু হল, তখন ভারত একটা বৃহৎ বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দোরগোড়ায় প্রায় পৌঁছে গেছে বলে মনে হতে থাকল। ভারত হয়ে উঠেছিল নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় কিছুটা–অনিচ্ছুক কিন্তু অপরিহার্য উপাদান, আর তার কারণ ছিল তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি। ভারতের অর্থনীতি খুবই ভাল ফল করতে শুরু করার পর ভারতের গণতন্ত্রও অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল।

১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকটা ছিল এমন একটা সময় যখন একের পর এক দুর্বল সরকার ভারতকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে দিশাহীন অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছিল। পৃথিবী দ্রুত বদলে যাচ্ছিল আর ভারতীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ছিল। ভারত অজস্র বিরোধ-বিতর্কের (ভি এস নইপল কথিত ‘মিলিয়ন মিউটিনিজ’-এর) মুখে পড়ছিল। জাতীয় স্তরে এমন উচ্চতার কোনও নেতা ছিলেন না যিনি এর মোকাবিলা করতে পারেন। মন্ডল–মন্দির প্রসঙ্গ– জাতিগত সংরক্ষণ–কেন্দ্রিক বিতর্ক ও অযোধ্যা-বিতর্ক দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। ঠিক এই সময় প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও ক্ষমতায় এসেছিলেন। নিজের দলের প্রবীণ নেতাদের, যে নেতারা প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের থেকে তিনি খুব সামান্যই সমর্থন পেয়েছিলেন।

রাও–এর মেধাবী রাজনৈতিক নেতৃত্বই নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য দেশে একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলেছিল।

রাও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন বলে তাঁকে যে ভাবে খাটো করা হত, সে কথা মাথায় রেখে একটা কথা না বললেই নয়। দেশ এখনও অবধি যে কজন এমন নেতাকে দেখেছে যাঁরা অটল হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, রাও ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি সমস্ত অতি–গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা গত দু’দশক ধরে ভারতের উত্থানের রেখাচিত্র তৈরি করে আসছে। এমন একটা সময় তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যখন তাঁর দলের লোকেরাই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রয়াসগুলিকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করছিল।

১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতের বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জও ঠিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হঠাৎ করে পৃথিবী একমেরুকেন্দ্রিক হয়ে গেছিল, আর ভারতের প্রধান সহযোগী সোভিয়েত ইউনিয়ন বাস্তবিক পক্ষে বিশ্বের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছিল। সেই সময়ে নয়াদিল্লিকে তার অর্থনৈতিক নীতিসমূহকে আরও কার্যকর ভাবে বৈদেশিক নীতির সঙ্গে যুক্ত করতেই হয়েছিল। অর্থনৈতিক সংস্কারের সাফল্য পেতে হলে ভারতকে যে পশ্চিমের এবং বিশেষ করে মার্কিন দেশের সমর্থন পেতে হবে, সে কথা মাথায় রেখে রাও ভারত-মার্কিন সম্পর্ক ফের জোরদার করার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। বিশ্বের কৌশলগত মানচিত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বকে তিনি স্বীকৃতি দিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে রাও যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন তা অন্য কোনও ভারতীয় নেতার ছিল না। ১৯৯২ সালে তিনি ইজরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেন, আবার ১৯৯৩ সালে তিনি তেহরানে গেলেন। ১৯৭৯–র বিপ্লবের পর তিনিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি ইরান পৌঁছলেন। তাঁকে ‘পুবে তাকাও’ নীতি নিতে হল, কারণ বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র সরে আসছিল পুবে, আর পূর্ব এশিয়ার ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিগুলির সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করার প্রয়োজন ছিল। অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ–ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান)–এর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ আরও প্রসারিত করারও প্রয়োজন ছিল। শুধু ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্যই নয়, চিনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের একটা প্রতিস্পর্ধী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যও তা জরুরি ছিল।

১৯৯০–এর গোড়ার দিককার কর্তৃত্বের ছাপ এখনও ভারতীয় বৈদেশিক নীতির সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়: নির্জোট আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে ইস্যুভিত্তিক জোট করা; মধ্যপ্রাচ্যে দিল্লির সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা; চিনের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল ভারসাম্য রাখার চেষ্টা; বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে আরও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কূটনীতি; ‘পুবে তাকাও’ ও ’পুবে কাজ কর’ নীতিসমূহ অনুযায়ী পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছে যাওয়া, এবং এনডিএ সরকারের পোখরান–২ পরমাণু পরীক্ষার পর জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়িয়ে চলা।

যখন এই সংস্কারের ফল ফলতে শুরু করল, তখন তা ভারতের রাজনৈতিক শ্রেণীকে আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠার আত্মবিশ্বাস জোগাল।

রাও–এর মেধাবী রাজনৈতিক নেতৃত্বই নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য দেশে একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলেছিল। যখন এই সংস্কারের ফল ফলতে শুরু করল, তখন তা ভারতের রাজনৈতিক শ্রেণীকে আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠার আত্মবিশ্বাস জোগাল। রাওয়ের উত্তরসূরিরা সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে থাকলেন কখনও প্রকাশ্যে, আর কখনও চুপি চুপি। তিন দশক আগে যে অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা হয়েছিল তা এমন একটা ভরবেগ তৈরি করল যে অটলবিহারী বাজপেয়ী, আই কে গুজরাল, এইচ ডি দেবগৌড়া, মনমোহন সিং এবং এখনকার নরেন্দ্র মোদির মতো বিভিন্ন দলমতের নেতারা এর সমর্থক হিসেবে এগিয়ে এলেন। এ ভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে গেল, আর তার পরিণতিতে নতুন সম্ভাবনা ও জোট তৈরি হল।

বিশ্বে ভারতের অবস্থান নির্ণয়ে ১৯৯১–এর সংস্কারের প্রভাব

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অর্থনৈতিক উত্থানের সম্ভাবনা ঘিরে ভারত সম্পর্কে পৃথিবীর পুনর্মূল্যায়ন শুরু হল। সংস্কারের ফলে দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হতে থাকল, এবং তা বিশ্বের সঙ্গে ভারত যে ভাবে সংযুক্ত হত তার অবয়ব বদলে দিল। এখন ভারতকে বড় বড় শক্তিরা সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে এবং সমস্ত বিশ্বজনীন মঞ্চের সদস্য ভারত। পরিবেশগত পরিবর্তন থেকে মহাসাগরীয় নিরাপত্তা, নতুন প্রযুক্তি থেকে বিশ্বায়ন, সব কিছুতেই ভারত এখন একটা নতুন ভূমিকা নিয়ে চলেছে। এই আত্মবিশ্বাস এসেছে মূলত তার অর্থনৈতিক সাফল্য থেকে। শুধু গত দেড় বছরেই ভারত একদিকে কোভিড–১৯ অতিমারির মোকাবিলা করেছে, এবং অন্যদিকে তার সীমান্তে চিনের আগ্রাসন প্রতিহত করেছে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ শিল্পে সর্বাধিক উন্নত রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল, সেই সময় এই অতিমারির মোকাবিলায় বিশ্বজনমত গড়ে তোলার প্রশ্নে নয়াদিল্লি একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছিল। আর এই সময়েই নয়াদিল্লিকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল তার সীমান্তে চিনা সৈন্যদের সঙ্গে একক ভাবে লড়াই করায়।

ভারতই প্রথম রাষ্ট্র যে শি জিনপিং–এর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)–কে আগ্রাসী পরিকাঠামো প্রকল্প হিসেবে বর্ণনা করে প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেছিল। আজ নয়াদিল্লির সেই সমালোচনা বিআরআই নিয়ে গোটা বিশ্বের ঐকমত্যের অংশ হয়ে গিয়েছে।

চিনকে রুখে দেওয়ার ঘটনাটি গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারতের কৌশলগত অবস্থানের অংশ। পশ্চিম যখন বেজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করছিল, তখনও বিভিন্ন ফ্রন্টে নয়াদিল্লি চিনকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছিল। ভারতই প্রথম রাষ্ট্র যে শি জিনপিং–এর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বি আর আই)–কে আগ্রাসী পরিকাঠামো প্রকল্প হিসেবে বর্ণনা করে প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেছিল। আজ নয়াদিল্লির সেই সমালোচনা বিআরআই নিয়ে গোটা বিশ্বের ঐকমত্যের অংশ হয়ে গেছে। চিনের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত ইন্দো–প্যাসিফিক নিয়ে যে মতামত তৈরি হয়েছে তা সম্ভব হত না যদি না ভারত এই ক্ষেত্রে এত উৎসাহী হত। আর কোয়াড তো কল্পনার জগতে থেকে যেত যদি না ভারত তার বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত মতামত স্পষ্ট ভাবে সামনে নিয়ে আসত।

ভারত অনেকগুলি ফ্রন্টে চিনকে বিশাল ভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং অতিমারির বিরুদ্ধে বিশ্বজনীন সমাধান খোঁজার পথে নেতৃত্ব দিয়েছে। অবশ্যই দেশ এই কাজটা করেছে নিজের স্বার্থ বজায় রাখতে এবং তা আরও সংহত করতে। কিন্তু তা করতে গিয়ে ভারত বিশ্বকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যখন পৃথিবীর বড় বড় শক্তিগুলো চিনকে চ্যালেঞ্জ করতে এগিয়ে এল, তখন তারা ভারতকে পেল একটা শক্তিশালী অংশীদার এবং বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু হিসেবে। বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশ হয়তো এই সব কথাকে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করছে না; কিন্তু বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলো যারা ভারতের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে তারা ভারতকে আবশ্যক অংশীদার হিসেবেই দেখছে।

ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পদ তাকে তার সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার শক্তি যুগিয়েছে। তার ফলে ভারত চলতি ক্ষমতার ভারসাম্যকে আরও ভাল ভাবে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পেরেছে।

বস্তুগত ক্ষমতার যে কোনও বিষয়গত মাপকাঠিতে মাপা হলে ভারত আজ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি উদীয়মান শক্তি, আর তার ফলাফলগুলো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বেশ স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে। ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পদ তাকে তার সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার শক্তি যুগিয়েছে। তার ফলে ভারত চলতি ক্ষমতার ভারসাম্যকে আরও ভাল ভাবে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারছে।

দেশের ভেতরকার সমস্ত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারত কী ভাবে চিনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতা হিসেবে তার উপযুক্ত ভূমিকা পালন করেছে, সেটাই হল আমাদের যুগের সত্যিকারের কাহিনি। ভারত এখনই বিশ্বজোড়া কৌশলগত সমীকরণগুলোকে বদলে দিচ্ছে, এবং যে নতুন শক্তির ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে তাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে ১৯৯১ সালের সংস্কার কর্মসূচি থেকে যে গতি পাওয়া গিয়েছিল তার ভিত্তিতে। তা এই ঘটনাকে নিশ্চিত করেছিল যে ভারতের ক্ষমতা তার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং বিশ্বজনীন আকাঙ্ক্ষার অবয়ব তৈরি করবে। আজ যে ভারত বলতে পারে সে বিশ্বজনীন কাঠামোয় একটি অগ্রণী ভূমিকা নিতে চায়—অন্যের তৈরি নিয়ম মানার বদলে সে নিয়ম তৈরি করতে চায়— তার মূলে আছে ভারতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি থেকে উদ্ভূত আত্মবিশ্বাস। ভারত যে এখন বিশ্বের শক্তি–কাঠামোয় একটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারছে, তার একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক ক্ষমতা সেই সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে।

আর সারা পৃথিবী ভারতের কথা শুনছে, কারণ গণতান্ত্রিক ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতি হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য এখন বিশ্বাসযোগ্য তথা লালনযোগ্য হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যবস্থা এখন আগের থেকে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে: বড় বড় শক্তিগুলো প্রকাশ্যে প্রতিযোগিতায় নামছে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমশ অকেজো হয়ে পড়ছে, আর অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ভেঙে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় ভারত এই সমস্ত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। আর সারা পৃথিবী ভারতের কথা শুনছে, কারণ গণতান্ত্রিক ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতি হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য এখন বিশ্বাসযোগ্য তথা লালনযোগ্য হয়ে উঠেছে। ভারতের নীতিপ্রণেতারা যে এখন এতটা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগোতে পারছেন, সেই ঘটনাটাই হল তিন দশক আগে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেই সংস্কার সেই শক্তিগুলোকে মুক্ত করেছিল যা দশকের পর দশক ধরে প্রতিক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক নীতির তলায় চাপা পড়েছিল। ভারতের বৈদেশিক নীতি আজ ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার সময় থেকে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে তাকে অনেকটাই গড়ে দিয়েছে ৩০ বছর আগের অর্থনৈতিক সংস্কারের ঐতিহ্য।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.