মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এক অনিবার্য পতনের সামনে দাঁড়িয়ে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ইউ এস) এমন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেটিকে রাশিয়া এবং চিনের বিরুদ্ধে এক নতুন ঠান্ডা লড়াই বলা যেতে পারে। এটিকে গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে লড়াই বলে তুলে ধরার চেষ্টা বলে চালানো হলেও সাধারণ মানুষ এ কথা মানতে নারাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এহেন অবস্থান গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে চিনা চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে নিজের বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা।
অন্য দিকে এ কথাও বলা যেতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধঃপতনের কথা ভাবার সময় এখনও আসেনি। দেশটির অর্থনীতি এখনও প্রাণবন্ত এবং তার নেপথ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য রকমের আর্থিক বৃদ্ধি এবং গবেষণা ও উন্নয়ন অগ্রগতি। জনসংখ্যাগত দিক থেকে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থাকার পাশাপাশি দেশটি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সামরিক শক্তিগুলির অন্যতম। কিন্তু দেশটির কূটনৈতিক ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি এবং বিশ্বব্যাপী দেশটির অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক জি ডি পি-তে তার অংশীদারিত্বের অনুপাতের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিশ্বব্যাপী মোট খরচের প্রায় ২৭.৩ শতাংশ নির্বাহ করে থাকে যেখানে একই খাতে চিনা ব্যয়ের পরিমাণ ২১.৯ শতাংশ।
সমৃদ্ধির গুণমান পরিমাপের প্রধান মাপকাঠি গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট (জি ডি পি) দর্শায় যে, বিগত চল্লিশ বছরে আমেরিকার অংশীদারিত্বের তেমন কোনও পরিবর্তন ঘটেনি এবং দেশটি এখনও বিশ্বের জি ডি পি-র ২৫ শতাংশের অধিকারী। ১৯৮০ সালে বৈশ্বিক জি ডি পি-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ ছিল ২৫.১৬ শতাংশ। চল্লিশ বছর পরেও এখন এই অনুপাতের পরিমাণ প্রায় একই, অর্থাৎ ২৪.১২ শতাংশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক জি ডি পি-তে তার অংশীদারিত্বের অনুপাতের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিশ্বব্যাপী মোট খরচের প্রায় ২৭.৩ শতাংশ নির্বাহ করে যেখানে একই খাতে চিনা ব্যয়ের পরিমাণ ২১.৯ শতাংশ। গবেষণা ও শিক্ষার নিরিখে শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক গন্তব্য রূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমোঘ আকর্ষণ দেশটিকে বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে প্রতিভাবান মানুষদের একজোট করার ক্ষমতা প্রদান করে। তবুও বিশ্বের নজরে মার্কিন বিপত্তিগুলি– প্রথমে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং পরবর্তী কালে ইরাক এবং আফগানিস্তানে বিপর্যয়কর হস্তক্ষেপ— তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অগ্রসর হওয়ার জায়গা করে দিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হল তার কূটনৈতিক ক্ষমতার অবক্ষয় এবং একাধিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এর একটি অন্যতম উদাহরণ হল, সেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর বিভাজন যেখানে জনমত সমীক্ষায় বারবার দেখা গিয়েছে যে, ৭০ শতাংশ রিপাবলিকান ভোটার বাইডেনকে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈধ বিজয়ী বলে মনে করেন না। ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে দেশটির আর্থিক ক্ষেত্রটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে মার্কিন পরিবারগুলি তাদের সম্পদের নিরিখে এখনও সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৮০ সাল থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপার্জন বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সমকক্ষ দেশগুলির তুলনায় সে দেশে এই বৈষম্যের মাত্রা অনেকটাই বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশটি মনে করেছে যে, উন্নততর গণতন্ত্র এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার দৌলতে সে যে কোনও প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে সক্ষম। কিন্তু বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটি জটযুক্ত হয়ে পড়েছে। সে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি দ্বিদলীয় পদ্ধতিতে কাজ করার ক্ষম্তা আর নেই।
পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি বন্দুক সংক্রান্ত হিংসা এবং জনগণের উপরে গুলি চালানোর ঘটনা থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র, গৃহহীনতা এবং মাদকাসক্তির মতো অবক্ষয়মূলক সামাজিক সমস্যাগুলির সঙ্গে যুঝতে অসমর্থ বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে এই ধারণা ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক অনিবার্য পতনের সম্মুখীন।
বিশ্বায়ন
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় অক্ষত থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার রূপরেখা নির্ধারণে সাহায্য করেছিল। এই ব্যবস্থার তিনটি ভিত্তি হল আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউ এন) ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও শ্রমের মান বৃদ্ধি করতে সহযোগী সংস্থাগুলিকে কাজে লাগানো এবং সর্বোপরি বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো সংস্থাগুলির দ্বারা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ ছাড়াও তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন, সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশনের মতো সামরিক জোটের শৃঙ্খল নির্মাণ করে, যদিও এগুলির মধ্যে শুধু মাত্র প্রথমটিরই এখনও অস্তিত্ব রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও উদীয়মান রাজনৈতিক প্রবণতার ফলে আমেরিকার বৈশ্বিক ভূমিকা এবং উদার আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিসর নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং ইউ এন ব্যবস্থা-সহ সর্ব ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশীদারিত্বকে সমালোচনার মুখে ফেলে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা সৃষ্ট বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে কৌশলের সঙ্গে ব্যবহার করে চিন প্রথমে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কারখানা রূপে ও তার পরবর্তী সময়ে এক ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি হিসেবে উঠে আসে। ইরাক এবং আফগানিস্তানে সন্ত্রাস ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোনিবেশ করার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিস্তীর্ণ অংশে নজর দিতে ব্যর্থ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও উদীয়মান রাজনৈতিক প্রবণতার ফলে আমেরিকার বৈশ্বিক ভূমিকা এবং উদার আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিসর নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং ইউ এন ব্যবস্থা-সহ সব ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশীদারিত্বকে সমালোচনার মুখে ফেলে।
এর ফলে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট রূপে নির্বাচিত হন এবং প্রচ্ছন্ন একাধিক সমস্যা স্পষ্ট আকার ধারণ করতে শুরু করে। ট্রাম্প প্রশাসন চিনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক যুদ্ধের উপরে মনোনিবেশ করে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবজ্ঞা করে এবং ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টি পি পি) থেকে নিজেদের সরিয়ে দেয়। এমনকি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আমেরিকার নিজস্ব সামরিক অংশীদার এবং মিত্রদেশগুলির প্রতি অবজ্ঞামূলক আচরণ করেন এবং দেশগুলির কাছে তাদের নিরাপত্তার জন্য ন্যায্য মূল্য প্রদানের দাবি জানান। এবং যখন সারা বিশ্ব কোভিড-১৯ অতিমারিতে আক্রান্ত হয়, তখন সেটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে আমেরিকা অস্বীকার করে।
চিন
চিনের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক স্পষ্ট অবক্ষয়ের সাক্ষী থেকেছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বৃদ্ধির নিরিখে বৈশ্বিক জি ডি পি-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান ১৯৫০ সালের ৫০ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে চিনের অংশীদারিত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। চিনের জনসংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার চার গুণ এবং আমেরিকার তুলনায় চিনের অর্থনীতি তিন গুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণা ও উন্নয়ন এবং স্টেম শিক্ষার মতো অন্য ক্ষেত্রগুলিও চিনে দ্রুত হারে বর্ধিত হচ্ছে। বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০ বছর পরে সম্ভাব্য চিনা আধিপত্যের একটি ধারণা এখনই করা যেতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন চিনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক যুদ্ধের উপরে মনোনিবেশ করে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবজ্ঞা করে এবং ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টি পি পি) থেকে নিজেদের সরিয়ে দেয়।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন সহায়তা যেভাবে ইউরোপ গড়ে তুলতে এবং ভারত ও অন্যান্য দেশের শিক্ষা ও কৃষি ক্ষেত্রগুলির রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল, ঠিক সেভাবেই চিন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিকাঠামো প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একাধিক দেশ কী ভাবে চিনা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে, সে নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হলেও চিনা প্রস্তাব যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চিন আফ্রিকার দেশগুলিকে ১২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করেছে এবং দেশগুলিতে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলেও বর্তমানে তার পক্ষে চিনের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। জি৭ মঞ্চ থেকে ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সর্বশেষ প্রস্তাব এখনও পর্যন্ত বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
আধিপত্য বজায় রাখা : নতুন ঠান্ডা লড়াই
নতুন ঠান্ডা লড়াইয়ের ছায়া ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রত্যুত্তরে সঙ্গতির অভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় চিনকে পরাজিত করার জন্য টি পি পি-সহ অ্যাফর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট-এর মতো অভ্যন্তরীণ সংস্কার কর্মসূচির উপরে ওবামার বিশেষ জোর দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে ট্রাম্প প্রশাসন গুরুত্ব দেয়নি। বরং কর, রফতানি নিয়ন্ত্রণ প্রবিধান এবং চিনা ছাত্রছাত্রীদের নির্দিষ্ট একাংশের উপরে বিধিনিষেধ আরোপের মতো একাধিক উপায় অবলম্বন করে তারা চিনকে দমন করার চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে আমেরিকার তরফে চিনকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের পথে প্রধান বাধা রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য দিকে বাইডেন প্রশাসন এখনও তার চিনা নীতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেনি। সামাজিক, পরিকাঠামোগত এবং পরিবেশগত কর্মসূচিতে ব্যাপক পরিমাণে সরকারি বিনিয়োগের প্রচেষ্টা মার্কিন কংগ্রেসের রাজনৈতিক অচলাবস্থার দরুন ব্যর্থ হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভবিষ্যৎ
এই সব বিশ্লেষণ অনেকাংশেই ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত হলেও তা সমান ও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতার উপরেও নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধ নিঃসন্দেহে ইউরোপে মার্কিন জোট ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত এবং শক্তিশালী করে তুলেছে। কিন্তু আগামী দু’বছরের মধ্যেই ট্রাম্প অথবা ট্রাম্পপন্থী কোনও ব্যক্তির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বহাল হওয়ার সম্ভাবনা জোটের কার্যকারিতাকে পুনরায় প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে এবং আমেরিকার আন্তর্জাতিক নীতিতে অনিশ্চয়তা এবং অসঙ্গতির সূচনা করতে পারে।
ট্রাম্প অথবা ট্রাম্পপন্থী কোনও ব্যক্তির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বহাল হওয়ার সম্ভাবনা জোটের কার্যকারিতাকে পুনরায় প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে এবং আমেরিকার আন্তর্জাতিক নীতিতে অনিশ্চয়তা এবং অসঙ্গতির সূচনা করতে পারে।
‘নো লিমিট’ বা ‘সীমাহীন’ রুশ-চিন অংশীদারিত্ব-সহ ইউক্রেন যুদ্ধ একাধিক চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশিয়া ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়া এক দেশ হয়ে থাকলেও বর্তমানে সে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকারী আমেরিকার প্রকল্পগুলিকে বানচাল করে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এক প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকাঠামোগত সমস্যাগুলি সুস্পষ্ট। তবুও দেশটির সামরিক শক্তি সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক এবং পৃথিবীব্যাপী না হলেও মার্কিন অর্থ ব্যবস্থার আধিপত্য সমীহ উদ্রেক করে। হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার বিশ্বদর্শনে পরিবর্তন আনার এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব প্রদানকারী সকলের চেয়ে উঁচুতে অবস্থানকারী দেশ হিসেবে নিজেকে দেখার মনোভাব বদলানোর সময় এসেছে।
১৯৪৫ সালে অর্জিত বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদ এখনও আমেরিকার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির এক প্রধান ভিত্তি। যত দিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল, তত দিন এমনটা মনে করা হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু আমরা এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যখন চিনা অর্থনীতি ইতিমধ্যেই মার্কিন অর্থনীতিকে অতিক্রম করে গিয়েছে এবং আগামী ২০ বছরের মধ্যে তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, যা সামরিক খাতে বিনিয়োগের নিরিখে চিনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ করে তুলবে। তার বৈশ্বিক অবস্থানের নিরিখে চিনের একটি নিজস্ব দর্শন রয়েছে এবং সেই দর্শন অনুযায়ী চিন নিজেকে মিডল কিংডম বা মধ্যবর্তী সাম্রাজ্য রূপে দেখে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এখনকার কর্তৃত্ববাদী অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, সে কথা তর্ক সাপেক্ষ। তবুও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভবিষ্যতে দেশটিকে সর্বোচ্চ না হলেও একটি অন্যতম প্রধান বৈশ্বিক শক্তি রূপে গণ্য করা হবে। যদিও এহেন অবস্থান বজায় রাখতে এবং চিনের সঙ্গে সফল ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আকর্ষণের ভিত্তিতে নিজের কূটনৈতিক দক্ষতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। নিরাপত্তা এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলির পাশাপাশি নারীদের অধিকার,পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখা এবং গণতন্ত্র ও জাতিগত সমতার মতো বিষয়গুলিতেও তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। জোট ব্যবস্থাগুলির মধ্যে আধিপত্য স্থাপনের পদ্ধতি তার জানা থাকলেও সেগুলিকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করে তুলতে হবে। সর্বোপরি, আমেরিকাকে চিনের মতো অন্য বৈশ্বিক শক্তিগুলির সঙ্গে সহাবস্থানের এমন পথ খুঁজে বের করতে হবে, যেটি তার বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদের উপরে নির্ভরশীল নয়। সমগ্র বিশ্ব ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক পরিণতির সঙ্গে যুঝছে। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন সংঘাতের ফলাফল গুরুতর হতে পারে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.