ভারতে নতুন রাষ্ট্রপতি: ঘটনাটির তাৎপর্য এবং প্রভাব
সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের ১৫তম রাষ্ট্রপতি রূপে নির্বাচিত হলেন। দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পদে তাঁর উন্নীত হওয়ার ঘটনাটিকে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত রূপে স্বাগত জানানো হয়েছে। এর নেপথ্যে প্রধান কারণটি হল দ্রৌপদী মুর্মু জনজাতি থেকে নির্বাচিত ভারতের সর্বপ্রথম ও কনিষ্ঠতম মহিলা রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্রৌপদী মুর্মুর ব্যাপক জয়কে রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শ নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রের মানুষ আনন্দের সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছে।
প্রাথমিক ভাবে দ্রৌপদী মুর্মু ক্ষমতায় থাকা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ-র প্রতিনিধি রূপে বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা যশবন্ত সিংহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যিনি ভারতের বিরোধী দলগুলির পক্ষের যৌথ প্রতিনিধি ছিলেন। দ্রৌপদী মুর্মু মোট ভোটের ৬৪.০৩ শতাংশ পেয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন। এন ডি এ-র সাংসদ ও বিধায়করা ছাড়াও বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ-র স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ-সহ ওয়াই এস আর সি পি, বি এস পি, এস এ ডি, শিবসেনা এবং জে এম এম-এর মতো অ-এন ডি এ দলগুলিও তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে এবং নির্বাচনে মুর্মুর পক্ষে মতদান করে।
প্রাথমিক ভাবে দ্রৌপদী মুর্মু ক্ষমতায় থাকা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ-র প্রতিনিধি রূপে বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা যশবন্ত সিংহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যিনি ভারতের বিরোধী দলগুলির পক্ষের যৌথ প্রতিনিধি ছিলেন।
গণতান্ত্রিক মুক্তির প্রতীক
রাষ্ট্রপতি রূপে দ্রৌপদী মুর্মুর নির্বাচন ব্যাপক প্রতীকী গুরুত্ব এবং আশার সঞ্চার ঘটায়। ভারতের সামাজিক ন্যায় রাজনীতির পরম্পরায় এই ঘটনা সত্যি সত্যিই ঐতিহাসিক। কারণ ভারতে এর আগে কখনও কোনও জনজাতির প্রতিনিধি যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি, শুধু এমনটাই নয়। প্রান্তিক জনজাতি সম্প্রদায় থেকে জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে কোনও উল্লেখযোগ্য নেতার উঠে আসার ঘটনাও এ দেশে বিরল। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রংপুরের এক জনজাতি নেতার অতি সাধারণ প্রেক্ষাপট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত দ্রৌপদী মুর্মুর অনুপ্রেরণামূলক সফর ভারতের সাংবিধানিক মূল্যবোধের অনস্বীকার্য সাক্ষ্য। তিনি তৃণমূল স্তরে স্থানীয় সংগঠনে কাজ করার মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এবং পরবর্তী সময়ে এক জন বিজেপি বিধায়ক রূপে নির্বাচিত হন। ২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত ওড়িশার বিজেডি-বিজেপি সরকারের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন তিনি। এ ছাড়াও ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপালের পদে বহাল ছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য এন ডি এ-র তরফে তাঁর নাম ঘোষণার পর থেকেই দেশ জুড়ে জনজাতি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে উদযাপনের ঘটনা লক্ষ করা গিয়েছে। কারণ ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে তাঁর উত্থান ভারতের প্রান্তিক জনজাতির মানুষের প্রতীকী মুক্তি এবং স্বীকৃতির অনুভূতিকেই মূর্ত করে তুলেছে। তাঁর নিজস্ব পটভূমি ও ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল থাকাকালীন জনজাতির মানুষদের ভূমি অধিকার রক্ষার্থে তাঁর পূর্ববর্তী প্রচেষ্টা এই প্রত্যাশারই জন্ম দিয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দেশের তফশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের প্রান্তিকীকরণ এবং দুর্দশার দিকে নজর দেবেন এবং সমাজের এই অরক্ষিত অংশগুলির বৃহত্তর সুরক্ষা সুনিশ্চিত করবেন।
রাষ্ট্রপতি পদের গুরুত্বকে তুলে ধরা
ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং তিনি সাংসদ ও বিধায়কদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা পরোক্ষ ভাবে নির্বাচিত হন। সংবিধানে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী-পরিষদের সাহায্য এবং পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যদিও এর অর্থ এই নয় যে, ভারতের রাষ্ট্রপতি পদটি সম্পূর্ণ রূপে খেতাবমাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস ম্যানরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, কয়েকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি এক স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠন এবং সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার নিরিখে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দল নিরঙ্কুশ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে বা ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে কোন দল সরকার গঠন করবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং দ্রুত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংক্রান্ত ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ গ্রহণ করা বা না করার স্বাধীনতাও রাষ্ট্রপতির রয়েছে। যদিও আজ পর্যন্ত পূর্ববর্তী সকল রাষ্ট্রপতিই এ হেন উপদেশ মেনে চলেছেন। যখন নিরঙ্কুশ সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনও শক্তিশালী জাতীয় সরকার ক্ষমতায় বহাল থাকে, তখন রাষ্ট্রপতির উপরোক্ত বিবেচনামূলক ক্ষমতা ব্যবহার করার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়ে। অতীতে কংগ্রেসের একদলীয় আধিপত্যের সময় (১৯৪৭-১৯৮৯) এমনটা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। এবং তাই সংসদে শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিজেপির রাজনৈতিক আধিপত্যের বর্তমান পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হতে পারে এমন রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম।
বিলের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কোনও আপত্তি থাকলে তিনি ‘পকেট ভেটো’র বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিলটি সংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা— বিলটিতে স্বাক্ষর না করা এবং মন্ত্রী-পরিষদের কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো— থেকে বিরত থাকতে পারেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনামূলক ক্ষমতা হল সংসদে পাস হওয়া বিলগুলিকে অনুমোদন দেওয়া। কোনও বিল নিয়ে রাষ্ট্রপতির আপত্তি থাকলে তিনি সেটিকে তাঁর সুপারিশ-সহ মন্ত্রী-পরিষদে ফেরত পাঠাতে পারেন (অর্থ বিল ছাড়া)। যদি মন্ত্রী-পরিষদ তাঁর সুপারিশগুলি অন্তর্ভুক্ত না করে বিলটি ফেরত পাঠায়, তা হলে রাষ্ট্রপতি বিলটিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মতি দিতে বাধ্য হন। বিলের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কোনও আপত্তি থাকলে তিনি ‘পকেট ভেটো’র বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিলটি সংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা— বিলটিতে স্বাক্ষর না করা এবং মন্ত্রী-পরিষদের কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো— থেকে বিরত থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিলটি মুলতুবি থাকবে। এ কথা লক্ষ্যণীয় যে, ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল থাকাকালীন দ্রৌপদী মুর্মু ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন সংক্রান্ত বিলটি তাঁর প্রশ্ন-সহ তৎকালীন রঘুবর দাসের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের কাছে ফেরত পাঠান। রাজ্যপালের অধিকারের আওতায় এই বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগকে জনজাতির স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করা হয়। সুতরাং এ বিষয়ে সকলের নজর থাকবে যে, তিনি কী ভাবে সংবিধানের রক্ষক এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম পুরোধা হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য ধার্য সাংবিধানিক সীমার মধ্যে থেকে তাঁর নতুন ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
এক কথায় বলতে গেলে, দ্রৌপদী মুর্মুর সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এবং অনুপ্রেরণামূলক রাজনৈতিক কর্মজীবন রাজনীতির সকল স্তরের দল ও মানুষের সমর্থন এবং প্রশংসা লাভ করেছে। রাষ্ট্রপতি পদের পবিত্রতা তখনই বজায় থাকবে, যদি সেটি বিভাজনের রাজনীতির অস্বচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠে ‘জাতীয় ঐক্যের এক প্রতীক’ রূপে বৃহত্তর স্থিতিশীলতা প্রদানে সক্ষম হয়। এমন এক সময়ে যখন ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসর একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক দলাদলির সাক্ষী থেকেছে, তখন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির প্রভাব এবং সদিচ্ছা জনকল্যাণ এবং স্থিতিশীল প্রশাসনের মতো বৃহত্তর লক্ষ্যের নিরিখে রাজনৈতিক সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.