Published on May 03, 2024 Updated 0 Hours ago

যেহেতু বিশ্ব ঠান্ডা লড়াই ২.০-র মধ্য দিয়ে পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  চিনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্বব্যাপী এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা  পুনর্বিন্যাসকে অনেকাংশে আকার দেবে।

ঠান্ডা লড়াই ২.০: দ্বিধাবিভক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মার্কিন-চিন-রাশিয়া দ্বন্দ্ব

সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও গতিপথ নিয়ে বিতর্ক তীব্রতর হচ্ছে। কেউ কেউ বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯১৪ সালের  অনিশ্চয়তার অনুরূপ বলে মনে করেন; কেউ কেউ বলেন যে, বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। আবার কেউ কেউ এটিকে ১৯৪৫ সালের সঙ্গে তুলনা করেন এবং আশঙ্কা করছেন যে, প্রাথমিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  চিনের মধ্যে একটি নতুন ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে। যাই হোকবর্তমান উত্তেজনাকে ঠান্ডা লড়াই ২.০-এর কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারেযা বিভক্ত বিশ্বব্যবস্থা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (৪আইআর) মাঝে এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য দিকে ড্রাগনবিয়ার মোডাস ভিভেন্ডি-র (চিন ও রাশিয়া) মধ্যে গভীর বিভাজনের প্রতীক। এই পটভূমিতেইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপ এবং ইরায়েল ও হামাসের মধ্যে সামরিক সংঘাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এই ঠান্ডা লড়াই ২.০-র একটি বহিঃপ্রকাশ। এই যুদ্ধগুলি একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের পাশাপাশি বিশ্বের এ হেন বিভাজনকেই দর্শায়, যা প্রতিটি ক্ষণস্থায়ী বছরের সঙ্গেই গভীরতর হতে থাকে। ২০২৪ সালটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি নতুন বৃদ্ধির সাক্ষী হতে চলেছেযেখানে উত্তর কোরিয়ার কর্মকাণ্ড এবং দক্ষিণ চিন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা, চিন ও রাশিয়ার ইন্ধন আসলে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান সংঘাতের সঙ্গে মিলিত হবে

 

এই পটভূমিতেইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপ এবং ইরায়েল ও হামাসের মধ্যে সামরিক সংঘাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এই ঠান্ডা লড়াই ২.০-র একটি বহিঃপ্রকাশ।

 

বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন  রাশিয়া একটি সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক ভাবে কম। যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার  হেন সংযম সামর্থ্যের অভাব বা বহুবিধ দ্বন্দ্বমূলক স্বার্থের কারণে নয়বরং বিশ্বব্যাপী সংঘাতের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়া থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বরং প্রত্যক্ষ যুদ্ধের পরিবর্তে এই প্রধান শক্তিগুলি কূটনীতিভূ-অর্থনৈতিক চাপ এবং লোহিত সাগরে সৃষ্ট সঙ্কটের ক্ষেত্রে যে আঞ্চলিক প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে – যেখানে যেখানে ইরান-সমর্থিত হুতিরা চিনা ও রুশ জাহাজের নিরাপদ অতিক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে – তা একটি জটিল সমীকরণে সম্পৃক্ত থাকার উদ্দেশ্যে কৌশলগত পরিসরের জন্য একটি অগ্রাধিকারকেই দর্শায়। এই পন্থা তাদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং উন্মুক্ত গতিশীল যুদ্ধের পরিসর অতিক্রম না করে নিজেদের প্রভাব জাহির করার সুযোগ করে দেয়। এই কৌশলগত অবস্থান – যা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং অবকাঠামোর ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে অথবা প্রক্সি যুদ্ধে পর্যবসিত হয় - ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরিখে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ই সব কিছুই এ হেন সূক্ষ্ম উপলব্ধিরও প্রতিফলন ঘটায় যেবিশ্বব্যাপী বাজারডিজিটাল শিল্প বিপ্লব এবং অভিন্ন সাধারণ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ দ্বারা আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে চিরাচরিত যুদ্ধের ব্যয় সম্ভাব্য লাভের চেয়ে অনেকটাই বেশি।

 

পারমাবিক অস্ত্র

ঠান্ডা লড়াই ২.০-র আলোকে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের পরিসরটি বর্তমান সময়ে একটি অসম্ভাব্য ফলাফল হিসাবে রয়ে গিয়েছে। এই সংযমের নেপথ্যের যুক্তিটি পারস্পরিক ভাবে নিশ্চিত ধ্বংসের মতবাদ দ্বারা পরিচালিত এ হেন কর্মকাণ্ডের ধ্বংসাত্মক পরিণতির পারস্পরিক স্বীকৃতির মধ্যে নিহিত। যাই হোকএটি পারমাণবিক আত্মতুষ্টির সমতুল্য নয়। বরং বিপরীতেবর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ ও অস্ত্র তৈরি তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারেযা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অনেক বড় পরিসরে ও আকারে একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দেয় এই প্রবণতাটি পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনমজুদ বৃদ্ধি  অস্ত্রাগারের আধুনিকীকরণ দ্বারা চিহ্নিত হবে। পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ইরানের মতো নতুন দেশের উত্থান লক্ষ করা যেতে পারে। এই বৃদ্ধিটি তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে এবং শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রধান শক্তিগুলির একটি কৌশলগত অবস্থানেও প্রতিফলিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। কারণ পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ভুল গণনা ও দুর্ঘটনাজনিত সম্পৃক্ততার ঝুঁকি বৃদ্ধি করার ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনার একটি জটিল স্তর নিযুক্ত হয়

 

এই সংযমের নেপথ্যের যুক্তিটি পারস্পরিক ভাবে নিশ্চিত ধ্বংসের মতবাদ দ্বারা পরিচালিত এ হেন কর্মকাণ্ডের ধ্বংসাত্মক পরিণতির পারস্পরিক স্বীকৃতির মধ্যে নিহিত।

 

বিশ্বব্যবস্থার বিভাজন

সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনৈতিক পরিসরটি বাণিজ্যপ্রযুক্তি  আর্থিক ব্যবস্থার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের দরুন ক্রমাগত বিভাজনের সাক্ষী হচ্ছে। এই প্রবণতা ঠান্ডা লড়াই ২.০-র বৈশিষ্ট্যযুক্ত বৃহত্তর উত্তেজনার প্রতিফলন ঘটায় এবং এ বছর বিশ্বব্যাপী অর্থব্যবস্থার পরিসরে তা গভীর ভাবে প্রসারিত হতে চলেছে এই খণ্ডিত  ভঙ্গুর  আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় ২০২৪ সালে জি২০ এবং ব্রিকস-এর মতো বড় অর্থনৈতিক ব্লকগুলি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন প্রত্যাশিত সবচেয়ে প্রাণবন্ত অর্থনীতিসম্পন্ন দেশগুলি সক্রিয় ভাবে মার্কিন ডলারের বিকল্প অন্বেষণ করার পাশাপাশি তা প্রয়োগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। মার্কিন ডলার দীর্ঘকাল ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য  অর্থের ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রেখে চলেছে। এই ধরনের পদক্ষেপগুলি বিশ্বব্যাপী আর্থিক কাঠামোর একটি উল্লেখযোগ্য পুনর্বিন্যাস ঘটাবে, যা একটি একক প্রভাবশালী মুদ্রার উপর নির্ভরতা হ্রাস করা এবং আরও বহুমুখী আর্থিক বিশ্বকে লালন করার ইচ্ছা দ্বারা চালিত হবে। এই কৌশলগত বৈচিত্র্যের লক্ষ্য শুধু মাত্র পরিবর্তিত ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা  আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল পরিবর্তনের প্রতিফলন নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং যে কোনও একক জাতির অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি বাফার প্রদান করা বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলের অপরিবর্তনীয় ব্যাঘাত বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে উল্লেখযোগ্য ভাবে অবদান রাখছে। এটি এমন একটি ঘটনা, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে পুনরায় আকার দিচ্ছে। ঠান্ডা লড়াই ২.০-র প্রেক্ষাপটেকৌশলগত আন্তর্জাতিক চোকপয়েন্টগুলির উপর নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। কৃষ্ণ সাগর এবং লোহিত সাগরের বাব-এল-মান্দেব প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথগুলি তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। কারণ দেশগুলি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগবিন্দুতে প্রভাব বিস্তারের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করছে একই সঙ্গে উত্তর সাগরের পথটি রাশিয়া ও চিনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসাবে ক্রমশ প্রাধান্য লাভ করবেযা চিরাচরিত শিপিং লেন বা জাহাজ চলাচলের পথের কৌশলগত বিকল্প হয়ে উঠবে। এই উন্নয়ন ভূমিভিত্তিক বাণিজ্য করিডোরের ক্রমবর্ধমান তাৎপর্যেরই সমান্তরাল। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর (আইএনএসটিসি) এবং সম্প্রতি প্রস্তাবিত ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডোর-এর (আইএমইসি) মতো উদ্যোগগুলি আন্তঃ-মহাদেশীয় বাণিজ্যকে সহজতর করার ক্ষেত্রে ক্রমশ কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিচ্ছে। এই মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি রুট বা বহুক্ষেত্রীয় সংযোগমূলক পথগুলি শুধু মাত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপায়ে বৈচিত্র্য আনবে না, বরং এমন একটি বিশ্বে মিত্রতা  অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলিকেও প্রতিফলিত করবে, যেখানে প্রথাগত সাপ্লাই চেন মডেলগুলিকে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে এই ঘটনাপ্রবাহের ফলাফল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব-সহ বিশ্ব বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে একটি আরও খণ্ডিত  প্রতিযোগিতামূলক পরিসর হয়ে উঠবে

 

কৃষ্ণ সাগর এবং লোহিত সাগরের বাব-এল-মান্দেব প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথগুলি তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। কারণ দেশগুলি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগবিন্দুতে প্রভাব বিস্তারের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করছে

 

চিনের ‘ডেথ বাই থাউজেন্ড কাটস’ পদ্ধতি

তাইওয়ানের প্রতি চিনের অবস্থান সমসাময়িক ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ  সংবেদনশীল বিষয় এবং চিনের তরফে একটি পূর্ণ মাত্রার সামরিক আগ্রাসনের বদলে তা ত্যাগের কৌশল দ্বারা চিহ্নিত হয়। এই ধরনের আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ ভাবে উড়িয়ে না দেওয়া গেলেও এটি যে জটিল আন্তর্জাতিক প্রভাব ফেলবে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ হেন আক্রমণকে সম্ভাব্য পরিস্থিতি বলে মনে করা হয় না। বরং তার পরিবর্তে চি এমন একটি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করছে বলে মনে করা হচ্ছে, যা কৌশলগত ভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ  আর্থ-সামাজিক বলপ্রয়োগের পাশাপাশি বর্ধিত সামরিক চাপকে সমন্বিত করে।

এই পদ্ধতিগত কৌশলটির লক্ষ্য হল ধীরে ধীরে তাইওয়ানের প্রতিরোধকে দুর্বল করা এবং দ্বীপটির উপর বেজিংয়ের প্রভাব আরও জোরদার করা। যখন জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য এবং তাইওয়ানের ডিপিপি প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে নির্বাচনের পর স্বাধীনতা লাভের জন্য অভ্যন্তরীণ সমর্থনকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক কৌশলগুলি পরিকল্পনা করা হয়েছে, তখন তাইওয়ান প্রণালী এবং দক্ষিণ চিন সাগরে সামরিক কৌশলগুলি শক্তি  অভিপ্রায়ের প্রদর্শন হিসাবে কাজ করে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধের মতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আসলে আর্থিক চাপ প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যেই গৃহীত হয়েছে। এই সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি তাইওয়ানের প্রতি চিনের দীর্ঘমেয়াদি ‘ডেথ বাই থাউজেন্ড কাটস’ কৌশলগত মনোভাবকেই দর্শায় এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ও আন্তর্জাতিক নিন্দার মতো নানাবিধ ঝুঁকি পরিচালনা করার প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গেই চিন সমন্বিতকরণের আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য বজায় রেখে চলে।

 

সম্ভাব্য রায়েল-প্যালেস্তাইন দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান

রায়েল-হামাস সংঘাত একটি দীর্ঘস্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা এবং ২০২৪ সালেও টিকে থাকার যথেষ্ট লক্ষণ বিদ্যমান। এটির একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বর্তমানে কম বলে মনে হলেও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল রয়ে গিয়েছে এবং আগামী বসন্তে বা গ্রীষ্মে এই যুদ্ধের হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ করা যেতে পারে। রায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের স্থায়ী আশা আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলেও, তা অর্জন করা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ মানবিক উদ্বেগে জর্জরিত। মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য সংঘাতের প্রসার ও প্রভাব আঞ্চলিক গতিশীলতাকে জটিল করে তুলছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে বাব-এল-মান্দেব প্রণালীতে বাণিজ্যিক জাহাজের উপর ইরান-সমর্থিত হুতিদের আক্রমণ বিশ্ব বাণিজ্যের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ইরান ব্রিকসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। জাহাজের উপর হুতিদের আক্রমণের ফলে দেশগুলি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অ গুড হোপের আশপাশে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের পথকে পুনরায় ব্যবহার রতে বাধ্য হচ্ছে। এই ঘটনাগুলি মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর উত্তেজনাকে প্রতিফলিত করে এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের জটিল বিন্যাসকে তুলে ধরে, যা এই অঞ্চলে এবং এর বাইরেও শান্তি ও নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

 

রায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের স্থায়ী আশা আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলেও, তা অর্জন করা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ মানবিক উদ্বেগে জর্জরিত।

 

রাশিয়ার যুদ্ধ আরোপণ এবং ইউরোপে নতুন ‘আয়রন কার্টেন’

২০২৪-এর দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে, রাশিয়া  ইউক্রেনের মধ্যে বিদ্যমান যুদ্ধটি অদূর ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে এবং এই সংক্রান্ত কোনও তাত্ক্ষণিক সমাধানের লক্ষণ নেই। যাই হোককূটনীতির নিরিখে আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। কারণ আগামী শরতে সম্ভাব্য আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই আলোচনাগুলি বাস্তবায়িত হলে তা এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করতে পারে। অন্তর্বর্তী সময়ে রাশিয়া বসন্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের মতো উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে প্রস্তুতযা সম্ভবত আগামী বছরগুলিতে যথেষ্ট রাজনৈতিক রদবদলের দিকে চালিত করবে।

সর্বোপরি, ইউক্রেনের আঞ্চলিক বিভাজনের সম্ভাবনা যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমী দেশগুলির মধ্যে সমন্বিত কৌশলগত ঐকমত্যের অনুপস্থিতির কারণে এই ঝুঁকি বেড়েছেবিশেষ করে ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ইউক্রেনের বিজয়ের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এবং ইউক্রেনের সীমানা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে। সামরিক সাহায্যের এই ধীর বণ্টন এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে দেশগুলি কূটনৈতিক পরিসরকে জটিল করে তোলে না, বরং ইউক্রেনের ভবিষ্য আঞ্চলিক অখণ্ডতা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে।

বিশ্ব যখন ঠান্ডা লড়াই ২.০-র ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সঙ্গে যুঝছে, তখন ন্যাটোর ইস্টার্ন ফ্ল্যাঙ্ক (এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড) এবং রাশিয়ার ওয়েস্ট ফ্ল্যাঙ্ক বরাবর একটি নতুন আয়রন কার্টেন (লৌহ পর্দা) আবির্ভূত হতে চলেছে এই ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনটি আর্কটিকের তুষারবলয় থেকে প্রসারিত হয়ে বাল্টিককৃষ্ণ সাগর এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের কৌশলগত জলসীমা পর্যন্ত প্রসারিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে – যা স্ক্যান্ডিনেভিয়াবাল্টিক রাষ্ট্রপুঞ্জ, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ এবং তুর্কিয়ের মতো এক সুবিশাল অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং আরও এক বার প্রথম ঠান্ডা লড়াইয়ের মতো একটি দ্বিখণ্ডিত ইউরোপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাঠামোয় এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষের সঙ্গে সমাপতিত হয় এবং তা হল ন্যাটোর ৭৫তম বার্ষিকীযা ওয়াশিংটনে উদ্‌যাপিত হবে। ঘটনাপ্রবাহের  হেন প্রতীকী সমন্বয় স্থানান্তরিত ভূ-রাজনৈতিক পরিসর এবং ন্যাটোর উত্তর ও পূর্ব সীমানা বরাবর উদীয়মান নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলা ও নিরাপত্তা জোরদার করার ক্ষেত্রে পুনর্নবীকৃত গুরুত্বকেই দর্শায়। এই নতুন বাধার নির্মাণ গঠন একটি নিছক ভৌত সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে জোট এবং তার প্রতিপক্ষের মধ্যে একটি গভীরতর মতাদর্শগত  কৌশলগত চ্যুতিকে দর্শায়, যা ২১ শতকের ভূ-রাজনৈতিক শৃঙ্খলায় একটি গভীর পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে।

 

রাশিয়া বসন্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের মতো উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে প্রস্তুতযা সম্ভবত আগামী বছরগুলিতে যথেষ্ট রাজনৈতিক রদবদলের দিকে চালিত করবে।

 

ভারতের ভূমিকা

আসন্ন বছরগুলি আন্তর্জাতিক সমীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সাক্ষী হতে চলেছেযা ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের অনিবার্য উত্থান দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে নিজের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি  জনসংখ্যাকৌশলগত অবস্থান  ক্রমবর্ধমান প্রভাব-সহ ভারত বিশ্ব মঞ্চে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত। এই উত্থান শুধুমাত্র ভারতের নিজস্ব বৃদ্ধির প্রতীক নয়, বরং একটি বৃহত্তর প্রবণতাকেও দর্শায়: আন্তর্জাতিক বিষয়গুলি নির্মাণে গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব। এই স্থানান্তরটি বিশেষত শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক ফোরাম যেমন জি২০ – যার সভাপতিত্ব করছে ব্রাজিল এবং রাশিয়ায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে দৃশ্যমান হবে। এই মঞ্চগুলি ভারতের নেতৃত্বে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলিকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতিউন্নয়নমূলক কর্মসূচি এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগুলিতে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেবে। এই দেশগুলি তাদের কণ্ঠস্বর  স্বার্থকে আরও জোরের সঙ্গে তুলে ধরে, তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতা  সিদ্ধান্ত গ্রহণের চিরাচরিত ভারসাম্য সম্ভবত একটি উল্লেখযোগ্য পুনর্গঠনের সাক্ষী থাকবে, যা বিশ্ব প্রশাসনে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।

 

২০২৪ সালে নির্বাচনী মহাচক্র

এ কথা বলাই বাহুল্য, ২০২৪ সালটি বিশ্ব রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী সময় হতে চলেছেযাকে ‘ইলেকশন সুপারসাইকল’ বা ‘নির্বাচনী মহাচক্র’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাম থেকে দক্ষিণ… রাজনৈতিক বর্ণালী জুড়ে জনপ্রিয়বাদের উল্লেখ্য উত্থানেও তা পরিলক্ষিত হয়। জনপ্রিয়বাদের এ হেন উত্থান চিরাচরিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি ক্রমবর্ধমান মোহ এবং আরও চরম বা প্রায়শই জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের দিকে পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। এই নির্বাচনের ফলাফলগুলি নীতি  জোটগুলিকে নতুন আকার দিতে পারে। কারণ রাজনৈতিক নেতারাও আরও সুরক্ষাবাদী  বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি অনুসরণ করবেন। এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অনির্দেশ্যতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নীতির পরিবর্তন এবং সম্ভাব্য ভাবে দীর্ঘস্থায়ী জোটের পুনর্বিন্যাসকে চালিত করবে। ২০২৪ সালের ‘নির্বাচনী মহাচক্র’ এ ভাবে একটি জটিল সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠেছে, যা আগামী বছরগুলিতে বিশ্ব রাজনীতির রূপরেখাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

 

ঠান্ডা লড়াই ২.০ দৃষ্টান্ত যথাযথ ভাবে বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সারমর্মকে ধারণ করেযা কৌশলগত প্রতিযোগিতাআঞ্চলিক দ্বন্দ্বভূ-অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দ্বিখণ্ডন  সামরিক বৃদ্ধির আতঙ্কময় দৃশ্যপট দ্বারা চিহ্নিত।

 

উপসংহার

যেহেতু বিশ্ব ঠান্ডা লড়াই ২.০-এর মধ্য দিয়ে নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছেতাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্বব্যাপী এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা ও পুনর্বিন্যাসকে অনেকাংশে আকার দেবে। ঠান্ডা লড়াই ২.০ দৃষ্টান্ত যথাযথ ভাবে বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সারমর্মকে ধারণ করেযা কৌশলগত প্রতিযোগিতাআঞ্চলিক দ্বন্দ্বভূ-অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দ্বিখণ্ডন  সামরিক বৃদ্ধির আতঙ্কময় দৃশ্যপট দ্বারা চিহ্নিত। এই উত্তেজনার সমাধান বা তার অভাব নিঃসন্দেহে একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক রূপরেখা নির্মাণ করবে।

 


ভেলিনা চাকারোভা ফেস-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Author

Velina Tchakarova

Velina Tchakarova

With over two decades of professional experience and academic background in security and defense Velina Tchakarova is an expert in the field of geopolitics. Velina ...

Read More +