Expert Speak Raisina Debates
Published on Nov 29, 2022 Updated 18 Days ago

নিজের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার সাম্প্রতিকতম প্রচেষ্টায় শি জিনপিং নির্লজ্জ ভাবে তাঁর সমর্থকদের ক্ষমতায় আসীন করেছেন এবং ২০তম পার্টি কংগ্রেসে কমিউনিস্ট ইয়ুথ লিগকে শক্তিহীন করে দিয়েছেন।

শি-এর ক্ষমতা দখল: রাজনৈতিক রদবদল এবং সি ওয়াই এল-এর ডানা ছাঁটা
শি-এর ক্ষমতা দখল: রাজনৈতিক রদবদল এবং সি ওয়াই এল-এর ডানা ছাঁটা

২০২২ সালের ২২ অক্টোবর চিনা জাতীয় রাজনীতি কট্টর কমিউনিস্ট প্রশাসন কায়েম করার লক্ষ্যে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ২০তম চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) কংগ্রেস মিটিংয়ের শেষে শি জিনপিং পরপর তৃতীয় বারের জন্য সি পি সি-র জেনারেল সেক্রেটারির পদ দখল করেন এবং আগামী পাঁচ বছরের জন্য চিনের অভ্যন্তরে সকল কার্যকর প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ব্যবস্থা করেন। প্রতি পাঁচ বছরে এক বার অনুষ্ঠিত হওয়া এই সমাবেশের জন্য তাঁর সর্বাঙ্গীন ও নিখুঁত পরিকল্পনা রিয়েলপলিটিকের নিরিখে এক শিক্ষণীয় উদাহরণ।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে শি যে ভাবে তাঁর পূর্বসূরি হু জিনতাওকে অপসারিত করেন, তা শি-এর সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছেও একই রকম পরিণতির রূঢ় ও নির্মম বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। উপরন্তু তাঁর সকল একনিষ্ঠ সমর্থকের নির্লজ্জ ক্ষমতায়ন এবং কমিউনিস্ট ইয়ুথ লিগের (সি ওয়াই এল) সদস্যদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের ঘটনা চিনে তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতাকেই দর্শায়।

প্রথমটি হল অভিজাত জোট, যার সদস্যরা কমিউনিস্ট পার্টির বর্ষীয়ান নেতৃবৃন্দ এবং উচ্চ পদাধিকারী আধিকারিকদের বংশধর।

দেং শিয়াওপিং-এর মৃত্যুর পর চিনা রাজনীতি বিগত ২৫ বছর যাবৎ কয়েকটি অকথিত ও নিরবচ্ছিন্ন প্রথা অবলম্বন করে এগিয়েছে। সি পি সি প্রধানত দু’টি সদস্য গোষ্ঠী দ্বারা  নির্মিত। প্রথমটি হল অভিজাত জোট, যার সদস্যরা কমিউনিস্ট পার্টির বর্ষীয়ান নেতৃবৃন্দ এবং উচ্চ পদাধিকারী আধিকারিকদের বংশধর। দ্বিতীয় সদস্য গোষ্ঠীটি হল পপুলিস্ট বা জনপ্রিয় জোট, যেটি সেই সব সি ওয়াই এল সদস্য দ্বারা গঠিত, যাঁরা তাঁদের পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতার বলে রাজনৈতিক ক্রমতালিকার উপরের দিকে উঠে আসতে সক্ষম হয়েছেন। জেনারেল সেক্রেটারির পদে যে কেউই বহাল থাকুন না কেন, সি পি সি বরাবরই এই দুই সদস্য গোষ্ঠীর মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখেছে। ফলে ২০১২ সালে জিয়াং জেমিং যখন শি জিনপিংকে জেনারেল সেক্রেটারির পদে বহাল করেন, তখন হু জিনতাওয়ের নেতৃত্বাধীন সি ওয়াই এল গোষ্ঠীও এক কার্যকর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য লি কেকিয়াংকে প্রিমিয়ারশিপে উন্নীত করে। নেতৃত্বের সাম্প্রতিকতম পালা বদলে এই ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ২৪ সদস্যের পলিটব্যুরো এবং সাত সদস্যের স্ট্যান্ডিং কমিটির মতো দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতাপুঞ্জগুলি থেকে সি ওয়াই এল গোষ্ঠীটিকে সম্পূর্ণ ভাবে অপসারিত করা হয়েছে। কেবল মাত্র হু চুনহুয়ার মতো গুটি কয়েক সি ওয়াই এল সদস্যই সি পি সি-র ২০৫ সদস্যবিশিষ্ট বৃহত্তর সেন্ট্রাল কমিটিতে নিজেদের স্থান ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। যদিও তাঁদের রাজনৈতিক শক্তিহীনতার বাস্তব চিত্র সুস্পষ্ট।

ঐতিহ্যের অবসান

এর পাশাপাশি শি জিনপিং অবশেষে চিনে রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ সংক্রান্ত অকথিত চুক্তিটি ভেঙে ফেলেছেন। সাধারণত একনায়কতন্ত্র দলের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ ক্ষমতাচ্যুতি এই সব নেতার জন্য বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকার খর্ব করার পাশাপাশি তাঁদের প্রাণনাশের আশঙ্কাকেও ত্বরান্বিত করে। মাও জে দংয়ের স্বৈরাচারী শাসনকালে চিন এহেন রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণের সাক্ষী থেকেছে যখন লিউ শাওকি-সহ একাধিক সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাকে খুন করা হয়। দেং শিয়াওপিং এই নির্মম প্রক্রিয়াটির প্রথা ভাঙতে তৎপর হন এবং সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অবসর গ্রহণের জন্য ৬৮ বছরের বয়সসীমা নির্দিষ্ট করেন। অবসর গ্রহণের চুক্তিতে এ কথাও অন্তর্নিহিত ছিল যে, এক বার অবসর গ্রহণ করলে উত্তরসূরিরা তাঁদের পূর্বসূরিদের শুদ্ধিকরণের চেষ্টা চালাবে না।

শি তাঁর শাসনের প্রথম কয়েক বছর এই প্রথা মেনে চললেও শীঘ্রই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই অবসরপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের নিম্ন ক্রমের দিকে অগ্রসর হয়। পরবর্তী বছরগুলিতে শি তাঁর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করতে প্রাক্তন জেনারেল সেক্রেটারিদের ঘনিষ্ঠ আমলাদের গ্রেফতার করেন ও তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও পূর্ববর্তী প্রশাসকদের সুরক্ষা এবং বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিষয়গুলি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। সাম্প্রতিক কালে নেতৃত্বের রদবদলের সময় শি এই ঐতিহ্যেও উল্লেখযোগ্য রকমের আঘাত হেনেছেন। সি পি সি সমাবেশ চলাকালীন হু জিনতাওকে প্রথম সারি থেকে জনসমক্ষে অপসারণের, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ঘটনাস্থলে প্রবেশ করার পর এমনটা করার প্রধান লক্ষ্য ছিল তাঁকে সারা পৃথিবীর সামনে অপমান করা।

সি পি সি সমাবেশ চলাকালীন হু জিনতাওকে প্রথম সারি থেকে জনসমক্ষে অপসারণের, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ঘটনাস্থলে প্রবেশ করার পর এমনটা করার প্রধান লক্ষ্য ছিল তাঁকে সারা পৃথিবীর সামনে অপমান করা।

চিনের সরকারি গণমাধ্যম এই ঘটনার একাধিক কারণ দর্শিয়েছে। বলা হয় যে, হু অসুস্থ  ছিলেন এবং সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তাই স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও সংশ্লিষ্ট ঘটনাটির একাধিক ছবি এক সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তব তুলে ধরে। হু চলে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না এবং তাঁর অপসারণের জন্য নিচুতলার কর্মীদের অনড় মনোভাব তাঁকে হতবাক করে। সর্বোপরি, কোনও চিকিৎসা-কর্মী তাঁকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেননি এবং যে ভাবে হু সভাস্থল ছেড়ে বেরিয়ে যান, তাতে তাঁর কোনও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দুর্বলতা চোখে পড়েনি। একই সঙ্গে যখন হু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন লি কেকিয়াং ছাড়া উপস্থিত সকল সদস্য হতবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন এবং করতালি দেওয়ার সাহস দেখাননি।

যোগ্যতার ঊর্ধ্বে আনুগত্য

তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে শি চিনা রাজনীতি থেকে সি ওয়াই এল গোষ্ঠীর সামগ্রিক অপসারণের মাধ্যমে এই ধারাকে সশক্ত করেন। লি কেকিয়াং এবং ওয়াং ইয়াংয়ের মতো বর্ষীয়ান নেতাদের অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয় এবং হু চুনহুয়াকে পলিটব্যুরো থেকে অবনমিত করা হয়। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে শি-এর ঘনিষ্ঠতম ছয় সহযোগী বহাল থাকেন এবং আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতার নিরিখে নির্বাচনের যাবতীয় সম্ভাবনা নির্মূল করা হয়।

স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের বয়স ভবিষ্যতে শি-এর জন্য কোনও রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে না। রাজনৈতিক ভাবে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দিং শুয়েশিয়াং ছাড়া অধিকাংশ সদস্যই ২০২৭ সালের পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসের সময় অবসর গ্রহণের দোরগোড়ায় থাকবেন। দিং এক জন কেরিয়ার পার্টি ম্যানেজার এবং তিনি ইতিপূর্বে শি-এর চিফ অফ স্টাফ রূপে কাজ করেছেন। এর পাশাপাশি কোনও মহিলা বা জাতিগত ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা পলিটব্যুরো বা স্ট্যান্ডিং কমিটিতে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাননি। এমনকি সেন্ট্রাল কমিটিতেও ২০৫ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ১১ জন মহিলা, অর্থাৎ মাত্র ৫ শতাংশ। শি নেতৃত্বের রদবদলের ক্ষেত্রে মহিলা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকার প্রচারের সকল ভনিতা প্রত্যক্ষেই খারিজ করেছেন।

শতবর্ষে এক বার ঘটা অতিমারিও ক্ষমতাসীন শক্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে কারণ তা চিনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিকূলতার জন্ম দিয়েছে।

এমনকি শি দেশের সর্বোচ্চ সি পি সি সামরিক শাখা সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনে (সি এম সি) যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি তাঁর পুরনো বন্ধু জেনারেল জাং ইয়ুশিয়াকে ৭২ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও ফার্স্ট ভাইস-চেয়ারম্যানের পদে উন্নীত করেছেন। শি-এর সঙ্গে জাং-এর গভীর ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং উভয়ের বাবাই ১৯৪৭ সালে নর্থ ওয়েস্ট আর্মি কোরে ছিলেন।

এর পাশাপাশি সি এম সি-তে পি এল এ নেভির আধা সদস্য পদ থাকলেও পিপলস লিবারেশন আর্মি (পি এল এ) এয়ার ফোর্সের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। নৌবাহিনীর প্রতিনিধি অ্যাডমিরাল  মিয়াও হুয়া তাঁর সমগ্র কর্মজীবনব্যাপী চিনা সেনার সদস্য ছিলেন এবং তিনি লেফটেনান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। তাঁকে ২০১৪ সালে পার্শ্বীয় ভাবে চিনা নৌবাহিনীতে স্থানান্তর করা হলেও এখনও তাঁকে সেনার প্রতিনিধি রূপে গণ্য করা হয়। ফলে যৌথ যুদ্ধ এবং আন্তর্পরিচালনার জন্য পি এল এ-র উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকা উচ্চ সামরিক প্রশাসনিক শাখাগুলির বর্ধিত এবং প্রায় সমান প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি এখনও অধরা রয়ে গিয়েছে। পি এল এ-র এই অতি-আধিপত্য চিনের আগ্রাসনের ধারণাকে প্রভাবিত করবে এবং দেশটির জমি সংক্রান্ত বিতর্কের উপর বিশেষ জোর দেবে।

এক দিকে পার্টি কংগ্রেসে শি-এর কার্যপরম্পরা চিনে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যকে তুলে ধরলেও অন্য দিকে এই ঘটনাপ্রবাহ শি-এর ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং আশঙ্কাকে  গভীরতর করে তুলেছে। চিনা কমিউনিস্ট সরকার শাসনের বৈধতা সুনিশ্চিত করতে অস্বস্তিতে পড়েছে। পূর্ববর্তী বছরগুলিতে তার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কর্মসূচির উপর ভর করে সাফল্যের মুখ দেখলেও — যা সে দেশের জনসাধারণকে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে চালিত করতে সমর্থ হয়েছিল — তৃতীয় দফার জন্য বর্তমান সরকারের একটি নতুন কর্মসূচি প্রয়োজন। সর্বোপরি, শতবর্ষে এক বার ঘটা অতিমারিও ক্ষমতাসীন শক্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে কারণ তা চিনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিকূলতার জন্ম দিয়েছে। ‘জিরো কোভিড’ বা ‘শূন্য কোভিড’ নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে শি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছেন।

সি পি সি প্রধানত দু’টি সদস্য গোষ্ঠী দ্বারা নির্মিত।

সি পি সি-র এই জোড়া ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে শি তাঁর শাসনের বৈধতা সুনিশ্চিত করতে জাতীয়তাবাদ এবং মার্ক্সবাদ ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়েছেন। যদিও এ কাজে তিনি এখনও সফল হননি। পার্টি কংগ্রেসে উপস্থাপিত সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে ‘লড়াই’-এর আগামী দিনগুলির উপর তাঁর মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত এক কঠিন ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে। সর্বোপরি চিনের বাহ্যিক পরিবেশও ক্রমশ প্রতিকূল হয়ে উঠছে। এই সব প্রতিকূলতার প্রেক্ষিতে শি-এর উচিত ছিল যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পার্টি নেতৃত্বের বিস্তৃত পরিসর থেকে নেতা নির্বাচন করা। কিন্তু তিনি এর বিপরীতে হেঁটে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দ্বারা পরিবৃত থাকা সমীচীন বলে মনে করেছেন। ফলে চিনের ভবিষ্যৎ আগের তুলনায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.