এই প্রতিবেদনটি ‘রিইগনাইটেড অ্যাজেন্ডাস: ট্রাম্প’স রিটার্ন অ্যান্ড ইটস গ্লোবাল রিপারকেশন’ সিরিজের অংশ।
হুল প্রত্যাশিত ২০২৪ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। অন্য যে কোনও অঞ্চলের মতো দক্ষিণ এশিয়াও ট্রাম্পের বিদেশনীতি সংক্রান্ত নানাবিধ দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। বিদেশনীতিতে পরিপূরক হয়ে ওঠার জন্য এবং চিনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ সংক্রান্ত ট্রাম্পের প্রচার প্রায়শই বিভ্রান্তিকর সঙ্কেত প্রেরণ করেছে। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের রূঢ়, অজ্ঞতাপূর্ণ ও হঠকারী পদক্ষেপ এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদটি দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেনের শাসনকালের সঙ্গে আরও বেশি ধারাবাহিকতা প্রদর্শন করতে পারে। তাই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ, নেপাল, মলদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলির জন্য কিছু সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ প্রকাশ্যে উঠে আসবে।
দুই কৌশলের মাঝে
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি দু’টি পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশলের এক সংমিশ্রণ: তাঁর দক্ষিণ এশিয়া কৌশল প্রাথমিক ভাবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারত, বিশেষ করে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘চিরকালের যুদ্ধ’কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এটির লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য অনুকূল বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করা, পাকিস্তানকে তার সন্ত্রাসবাদী বাস্তুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে চাপ দেওয়া এবং ভারতের সঙ্গে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। ফলস্বরূপ, ট্রাম্প আফগানিস্তানে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে শুরু করেন। তবে ২০১৯ সালের মধ্যে তিনি মার্কিন সেনাদের শর্তসাপেক্ষে প্রত্যাহারের মাধ্যমে আফগানিস্তানে অবিরাম যুদ্ধ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। ট্রাম্প সরকার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তালিবানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। আবার অন্য দিকে আফগানিস্তানের সরকারের প্রতি বিদেশি ত্রাণ হ্রাস করেছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। তালিবানকে মোকাবিলা করার জন্য দেশটির সাহায্য নেওয়া সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আফগানিস্তানকে সুরক্ষিত করার জন্য একটি স্থিতিশীল সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রেও আমেরিকা পাকিস্তানকে অন্যতম প্রধান বাধা হিসাবে বিবেচনা করেছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ট্রাম্প পাকিস্তানকে ‘মিথ্যা কথা ও প্রতারণা’র দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন, যার পরে ইসলামাবাদের নিরাপত্তা ত্রাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্পের চোখে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের কোনও লেনদেনমূলক সুবিধা ছিল না।
তালিবানকে মোকাবিলা করার জন্য দেশটির সাহায্য নেওয়া সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আফগানিস্তানকে সুরক্ষিত করার জন্য একটি স্থিতিশীল সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রেও আমেরিকা পাকিস্তানকে অন্যতম প্রধান বাধা হিসাবে বিবেচনা করেছিল।
একই সময়ে ট্রাম্পের মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সার্বভৌমত্ব, শান্তি, অবাধ ও পরিপূরক বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও নিয়মের উপর জোর দিয়ে চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছে। এক দিকে যখন এই মূল্যবোধভিত্তিক আদেশ বজায় রাখার জন্য আমেরিকা ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করেছিল, তখন অন্য দিকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মলদ্বীপ এবং নেপালের মতো ছোট দেশগুলিকেও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে মলদ্বীপে তার কূটনৈতিক মিশন ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) শীর্ষ উত্সগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে। অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য শ্রীলঙ্কা এবং নেপালকেও মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) প্রকল্পগুলির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রতি ট্রাম্পের মনোযোগের অভাবও এই দেশগুলির সঙ্গে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের সূচনা করেছে।
তাঁর নিরাপত্তা ভঙ্গি বৃদ্ধি করা এবং এই অঞ্চলের রসদ মজুদ করার জন্য তাঁর জেদ প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহায়তা, সহযোগিতা ও আলোচনার পথ প্রশস্ত করেছে। মলদ্বীপ একটি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্টে (এসিএসএ) স্বাক্ষর করেছে এবং বাহিনী চুক্তির স্থিতি পুনর্নবীকরণ নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকা জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) এবং এসিএসএ-তে স্বাক্ষর করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবুও, এই শক্তিশালী সম্পর্ক, বাণিজ্য যুদ্ধ, চিনের উপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য বিকল্প খোঁজার ধারাবাহিক আহ্বান, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) প্রতি ভূ-অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়াকে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পুরোভাগে তুলে ধরেছে এবং ছোট দেশগুলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সতর্ক ভারসাম্যমূলক মনোভাব গ্রহণে বাধ্য করেছে।
বাইডেনের ধারাবাহিকতা
ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেনও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রে একই দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতেন। তাঁর শাসনকালে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব হ্রাস পায়। ২০২১ সালের ৩০ অগস্ট আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বাইডেনের হঠকারী ও অবিবেচক সিদ্ধান্তের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা কমিয়ে এনেছিল। তবুও, বাইডেন মানবিক সহায়তা পুনরায় চালু করেছিলেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ত্রাণ এবং ৯/১১-এর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বন্ধ থাকা আফগান তহবিল ভাগ করার জন্য একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রত্যাহারের ফলে পাকিস্তান ও তার সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতার নিরিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহনশীলতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছয়। ট্রাম্প প্রশাসনের পতনের পর ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রথম বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে বাইডেনের যোগাযোগ আসলে পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যকেই দর্শায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে এবং স্পষ্টতই দিল্লির বিপরীতে হেঁটে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে ওকালতি করে।
অন্য দিকে, বাইডেন ভারতকেও এই অঞ্চলে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা নেওয়ার জন্য জোর দিচ্ছে এবং নেপাল এমসিসি ও কলম্বো পোর্ট সিটির মতো প্রকল্পগুলি ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং সমন্বয়ের সাক্ষী থেকেছে। বাইডেনের প্রশাসন ট্রাম্পের তুলনায় পরিপূরকতা ও লেনদেনমূলক সুবিধা নিয়ে কম উদ্বিগ্ন থাকলেও তাঁর নিজস্ব নীতিও গণতন্ত্রকেন্দ্রিক থেকেছে, যেমনটা বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে এবং স্পষ্টতই দিল্লির বিপরীতে হেঁটে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে ওকালতি করে।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন এবং কী কী ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে?
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন সম্ভবত তাঁর পূর্বসূরির নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও কিছু দ্বন্দ্ব অবশ্যই থাকবে, যেমনটা তাঁর প্রথম মেয়াদে দেখা গিয়েছে।
পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে সুসংহত পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। সন্ত্রাস দমন ও উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের উপস্থিতি ও প্রভাব রোধ করতে ও চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের সম্প্রসারণ আটকাতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। গণতন্ত্র ও দেশ গঠনের উপর ট্রাম্পের কম গুরুত্ব তালিবানদের জন্য লাভজনক হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনও অর্থনৈতিক বা কৌশলগত সুবিধা না থাকা এই দু’টি দেশে ট্রাম্প কতটা বিনিয়োগ করবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এই অঞ্চলের অন্য যে সব দেশ এখনও তাদের অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামান্যই অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, উন্নয়ন সহায়তা এবং এফডিআই অব্যাহত রাখবে। এর ফলে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিও নজরে উঠে আসবে না। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য ট্রাম্পের উদ্বেগের অভাব একটি সম্ভাব্য বিরক্তির অবসান ঘটাবে। এটি বাংলাদেশের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে, যেখানে সম্প্রতি শাসনের পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ মতাদর্শের মাধ্যমে ট্রাম্প সম্ভবত ভারতকে এই অঞ্চলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার সুযোগ করে দেবেন।
দেশগুলি সমালোচনা এবং মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে দূরে সরে থাকলে তা হোয়াইট হাউসের তরফে সমালোচনা ও চাপের সৃষ্টি করবে।
ভারতের সঙ্গে ট্রাম্পের সহযোগিতা এবং চিনের প্রতি সংঘাতপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করবে। ট্রাম্প চান যে, চিনের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই ছোট দেশগুলি একটি মুক্ত, অবাধ এবং সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করুক। দেশগুলি সমালোচনা এবং মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে দূরে সরে থাকলে তা হোয়াইট হাউসের তরফে সমালোচনা ও চাপের সৃষ্টি করবে। একই ভাবে, ট্রাম্পের সময় শুরু হওয়া বেশ কয়েকটি প্রকল্প ও আলোচনা হয় স্থগিত করা হয়েছে বা এখনও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এমসিসি এবং স্টেটাস অফ ফোর্সেস (সোফা) চুক্তি। দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়ন সহযোগিতার রাজনীতিকরণের পাশাপাশি ট্রাম্পের লেনদেনমূলক এবং অবিবেচক বিদেশনীতির দৃষ্টিভঙ্গি এই বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের নেবারহুড স্টাডিজ ইনিশিয়েটিভ-এর অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
অভিষেক কুমার ওআরএফ-এর ইন্টার্ন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.