কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার (সিপিসি) সেন্ট্রাল কমিটির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য ও মিনিস্টার অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স ওয়াং ইয়ের আমন্ত্রণে নেপালের ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ও মিনিস্টার অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠ ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত চিন সফর করেন। প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনা চলাকালীন উভয় পক্ষই ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাস্তবায়ন পরিকল্পনা স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়। বেজিংয়ের বিলিয়ন ডলারের মেগাপ্রজেক্ট বিআরআই-এর অধীনে গত বছর নেপালে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি ‘সিল্ক রোডস্টার’ মঞ্চ চালু করেছিল। সিল্ক রোডস্টার হল এমন একটি নতুন মঞ্চ, যা ব্যবহারিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করতে এবং চিন, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের সুবিধার্থে পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেমনটা এর ধারণাপত্রেও বর্ণিত হয়েছে। প্রস্তাব করা হয় যে, এই অনন্য ‘সিল্ক রোডস্টার’ উদ্যোগটি বিআরআই-এর সঙ্গে যুক্ত আরও প্রচলিত হার্ড পাওয়ার প্রকল্পগুলির তুলনায় বেজিংয়ের একটি সফট পাওয়ার পদ্ধতিরই প্রতিনিধিত্ব করে।
চিন বেশ কিছু বাধ্যতামূলক কারণে নেপালে কৌশলগত ভাবে তার সফট পাওয়ারকে কাজে লাগাচ্ছে। নেপাল এশিয়ার দু’টি বড় শক্তি অর্থাৎ ভারত এবং চিনের মধ্যে অবস্থিত, যা এটিকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ করে তোলে। শিক্ষা, পর্যটন এবং স্বাস্থ্যকে ‘নিয়োগ’-এর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চিন তার প্রভাবের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারণ করা, দক্ষিণ এশিয়ায় তার উপস্থিতি জোরদার করা এবং এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব প্রতিহত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কাঠমান্ডুর ভূ-কৌশলগত অবস্থান, বিশেষ করে তিব্বতের নৈকট্য বেজিংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নেপালে তিব্বতীয় নির্বাসিতদের দ্বারা প্রতিবাদ বা কার্যকলাপ চিন-বিরোধী বা তিব্বতের স্বাধীনতার সমর্থক বলে বিবেচিত এবং তা সম্ভাব্য ভাবে চিনের অভ্যন্তরে তিব্বতিদের মধ্যে অনুরূপ অনুভূতিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। এটি চিনের সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং জাতিগত সংখ্যালঘু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য সরাসরি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
চিন বেশ কিছু বাধ্যতামূলক কারণে নেপালে কৌশলগত ভাবে তার সফট পাওয়ারকে কাজে লাগাচ্ছে। নেপাল এশিয়ার দু’টি বড় শক্তি অর্থাৎ ভারত এবং চিনের মধ্যে অবস্থিত, যা এটিকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ করে তোলে।
নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে এবং দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করার মাধ্যমে চিন নিরাপত্তার হুমকি প্রশমিত করতে এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায়। সফট পাওয়ার সাধনীর মাধ্যমে নেপালে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ক্ষমতার চিরাচরিত ভারসাম্যকেও পরিবর্তন করছে। ঐতিহাসিক ভাবে, ভৌগোলিক নৈকট্য, অভিন্ন সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক সংযোগের কারণে নেপাল ভারতের প্রভাব বলয়ের মধ্যে ছিল। যাই হোক, নেপালে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পর্যটনে চিনের কৌশলগত বিনিয়োগ ভারতের প্রভাবের প্রতি ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে, যার ফলে বেজিং এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
পর্যটন
নেপাল তার বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও মাউন্ট এভারেস্টের মতো সুউচ্চ শৃঙ্গের জন্য বিখ্যাত এবং একটি আদর্শ পর্যটন গন্তব্যও বটে। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডু ও বেজিং পর্বতারোহণ এবং পর্যটনে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরবর্তী কালে দুই দেশের মধ্যে পর্যটন খাতে অসংখ্য চুক্তি হয়েছে। ২০১৪ সালে মোট ১২৩৮০৪ জন চিনা নাগরিক নেপাল ভ্রমণ করেছিলেন। যাই হোক, ২০১৫ সালে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কারণে নেপালে আসা চিনা পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে, প্রায় অর্ধেকে অর্থাৎ ৬৪৬৭৫-এ নেমে এসেছে (দ্রষ্টব্য সারণি ১)। ক্রমহ্রাসমান পর্যটকের সংখ্যাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর নেপাল চিনা পর্যটকদের জন্য একটি ভিসা অব্যাহতি উন্মোচন করে, তাঁদেরকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা দর্শকদের মতো একই সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। ‘ফ্রি-ভিসা’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়। নেপালে চিনা পর্যটকদের জন্য পর্যটন অভিজ্ঞতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চিনা পর্যটকদের জন্য একটি নির্বিঘ্ন ও আনন্দদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিত করার স্বার্থে পর্যটক গাইডদের চিনা ভাষার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালে নেপাল চিনা ভাষায় তার প্রথম ইন্টারেক্টিভ ট্যুরিজম ওয়েবসাইট চালু করে আরও বেশি সংখ্যক চিনা পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করেছে। নেপাল ট্যুরিজম বোর্ডের উদ্যোগে দেশের প্রধান পর্যটন প্রচার সংস্থা চিনাভাষী ভ্রমণকারীদের সঙ্গে কার্যকর ভাবে জড়িত থাকার জন্য একটি বিশেষ ওয়েবসাইটও তৈরি করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ চিনা পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে ১০৪৬৬৪ থেকে ২০১৮ সালে ১৫৩৬৩৩ হয়েছে (দ্রষ্টব্য সারণি ১)। যাই হোক, ২০২০, ২০২১, ২০২২ সালে অবশ্য কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে পর্যটনে ভাটা পড়েছে (দ্রষ্টব্য সারণি ১)।
সারণি ১
বর্ষ
|
চিনা পর্যটকদের সংখ্যা
|
২০১৪
|
১২৩৮০৫
|
২০১৫
|
৬৪৬৭৫
|
২০১৬
|
১০৪০০৫
|
২০১৭
|
১০৪৬৬৪
|
২০১৮
|
১৫৩৬৩৩
|
২০১৯
|
১৬৯৫৪৩
|
২০২০
|
১৯২৫৭
|
২০২১
|
৬১৯৮
|
২০২২
|
৯৫৯৯
|
২০২৩
|
৬০৮৭৬
|
(নেপালের পর্যটন পরিসংখ্যান, মিনিস্ট্রি অব কালচার, ট্যুরিজম অ্যান্ড সিভিল এভিয়েশন)
২০১৯ সালে নেপাল রেকর্ড হারে ১৬৯৫৪৩ জন চিনা পর্যটককে স্বাগত জানিয়েছে (দ্রষ্টব্য সারণি ১)। ওই একই বছরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপালে একটি সফল রাষ্ট্রীয় সফর করেছিলেন। সেই সময় কাঠমান্ডুর বাসিন্দারা তাঁকে উষ্ণ ভাবে স্বাগত জানাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন। এই দৃশ্যটি চিনা জনগণের উপর একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখেছিল, যা আরও বেশি সংখ্যক চিনা পর্যটককে নেপালের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। নেপালে চিনের রাষ্ট্রদূত হাউ ইয়ানকি উল্লেখ করেছেন, নেপালের অনন্য তুষারময় ভূগোল এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি উপভোগ করার আশায় চিনা পর্যটকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি করে আগ্রহী হয়েছেন। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রদূত ভিজিট নেপাল ইয়ার ২০২০ প্রচারের উদ্দেশ্যে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন পর্যটন সাইটে নিজের বেশ কয়েকটি ছবিও পোস্ট করেন। তিনি লিখেছেন, ‘ইতিহাস, বৈচিত্র্য এবং সুন্দর প্রকৃতিবিশিষ্ট নেপাল পর্যটনের দাবি রাখে।’
২০১৯ সালে নেপাল রেকর্ড হারে ১৬৯৫৪৩ জন চিনা পর্যটককে স্বাগত জানিয়েছে (দ্রষ্টব্য সারণি ১)। ওই একই বছরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপালে একটি সফল রাষ্ট্রীয় সফর করেছিলেন। সেই সময় কাঠমান্ডুর বাসিন্দারা তাঁকে উষ্ণ ভাবে স্বাগত জানাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে নেপালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে চিন পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রচারে একটি হিতৈষী প্রতিবেশী এবং বিশ্বনেতা হিসাবে নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। ২০২৩ সালে নেপালের জিডিপি-তে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল প্রায় ৬.৭ শতাংশ। বর্ধিত পর্যটন নেপালে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসে এবং চিন যেহেতু পর্যটকদের একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে, নেপালের অর্থনীতিও এই পর্যটন প্রবাহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই অর্থনৈতিক নির্ভরতা চিনকে তার স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলার জন্য নেপালের নীতিগুলিকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারে। ২০১৭ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (টিএইচএএডি) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পরে বেজিং চিনা নাগরিকদের উপর সিওল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উপরন্তু, আন্তঃপ্রণালী পর্যটন প্রায়শই চিন এবং এর পর্যটন সংস্থাগুলির দ্বারা রাজনৈতিক কারসাজির শিকার হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় চিন একতরফা ভাবে তাইওয়ানে ভ্রমণকারী পর্যটক ও ছাত্রদের সংখ্যা হ্রাস করে এবং ২০১৯ সালে তাইওয়ানে চিনা পর্যটকদের ভ্রমণের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। উপরন্তু, পর্যটনের সাহায্যে নেপালে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে চিনকে দক্ষিণ এশিয়ায় তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এবং ভারতের আধিপত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহায্য করেছে, যার ফলে এই অঞ্চলে চিনের কৌশলগত উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।
শিক্ষা
সফট পাওয়ার বিকাশ ও অগ্রগতির জন্য শিক্ষাকে সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে চিনে ছাত্রদের আগমন ২০১১ সালে ৬৮৭৯ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ১৮৯৬৬-তে দাঁড়িয়েছে, যা ১৭৬% বৃদ্ধিকেই দর্শায়। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে চিন নেপালে দক্ষ মানব সম্পদের বিকাশকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে পাঁচ বছরে ১৫০০টি বৃত্তি প্রদানের একটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম বা বৃত্তিমূলক কর্মসূচির সূচনা করেছে। আর একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল এই যে, নেপাল আনুষ্ঠানিক ভাবে ২০১৭ সালে বিআরআই-তে যোগদান করে। এই অন্তর্ভুক্তি নেপালি শিক্ষার্থীদের জন্য সিল্ক রোড কর্মসূচির মাধ্যমে প্রদত্ত বৃত্তি-সহ চিনা সরকারি বৃত্তি লাভের অতিরিক্ত সুযোগ করে দিয়েছে। ২০১৯ সাল নাগাদ আনুমানিক ৬৪০০ জন নেপালি শিক্ষার্থী চিনে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ৭১ জন নেপালি শিক্ষার্থী চিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ার জন্য চিনা সরকারের বৃত্তি পেয়েছে।
উপরন্তু, সিপিসি-র উদ্যোগে কনফুসিয়াস ক্লাসরুম নেপালে চিনা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে চিনের সফট পাওয়ার কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাঠমান্ডুর লার্নিং রিয়েলম ইন্টারন্যাশনাল (এলআরআই) স্কুলে প্রায় ১৬০০ জন তরুণকে বাধ্যতামূলক ভাবে চিনা ভাষা প্রশিক্ষণ করতে হয়। সর্বোপরি, চিন ২০১৫ সালে গোর্খা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দরবার হাই স্কুলের পুনর্নির্মাণে সম্পূর্ণ অর্থায়ন করেছে। ৮৫০ মিলিয়ন টাকার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয় ভবনের সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ হয়েছে। চিন নেপালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কূটনীতি এবং জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকে কাজে লাগিয়েছে। কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, শিক্ষা বৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে চিন নেপালি জনগণের মধ্যে চিনা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে চায়।
স্বাস্থ্য
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে যখন একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের দরুন নেপালে ব্যাপক ধ্বংস ও প্রাণহানি ঘটেছিল, চিন তার পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় নেপালকে সহায়তা করার জন্য দ্রুত সাহায্য ও সহায়তা জোগায়। নেপালে প্রাথমিক চিনা উদ্ধার অভিযানে ৬২ জন ব্যক্তি সম্পৃক্ত ছিলেন, যার মধ্যে ৪০ জন উদ্ধারকারী, ১০ জন চিকিৎসা পেশাদার, ১২ জন সিসমিক এক্সপার্ট বা ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং ছ’টি স্নিফার কুকুর ছিল। উপরন্তু, ৫৮ সদস্যের একটি পৃথক মেডিক্যাল টিম ১৩ টন ওজনের চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে এসেছিল। এর পাশাপাশি চিন পুনর্গঠন প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে নেপালকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে এবং নেপালের পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নেপালে তহবিল ও হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে চিন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে সমর্থন করা এবং নেপালের নাগরিকদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিনের সাহায্য প্রকল্পের অংশ হিসাবে নির্মিত সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের একটি নতুন অস্ত্রোপচার ভবনের উন্মোচন করা হয়েছে এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিনের গুয়াংঝো কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড দ্বারা শুরু করা একটি সংস্কার প্রকল্পের অধীনে বিদ্যমান সুবিধাগুলির সংস্কার করা হয়েছে। চিন কোভিড-১৯ অতিমারি চলাকালীন নেপালের সঙ্কটের সময়ে কাঠমান্ডুর সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতা করেছিল। চিন নেপালে কোভিড-১৯ টিকা সরবরাহ করেছে, দেশটির টিকাকরণ প্রচেষ্টায় অবদান রেখেছে। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অনুদান সহায়তা হিসেবে নেপালকে কোভিড-১৯ টিকার ১০ লাখ ডোজ প্রদানের ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি ৬১ মিলিয়ন চিনা ইউয়ানের সহায়তায় সিন্ধুপালচকে একটি ৩৯ শয্যাবিশিষ্ট চৌতারা হাসপাতালের পুনর্গঠন করা হয়েছে। হাসপাতাল নির্মাণ নেপালি জনগণের মধ্যে সদিচ্ছা ও কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি একটি পছন্দের উন্নয়নমূলক অংশীদার হিসেবে চিনের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করে। এটি স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ানোর লক্ষ্যে চিনের সফট পাওয়ার কূটনীতির প্রক্ষেপণের উদাহরণকেও দর্শায়।
নেপালে তহবিল ও হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে চিন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে সমর্থন করা এবং নেপালের নাগরিকদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে।
উপসংহারে বলা যায়, হিমালয়ের কোলে অবস্থিত দেশটিতে চিনের উপস্থিতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক চিনা ভাষার পর্যটন ওয়েবসাইট চালু করা হোক, চিনা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচারের জন্য কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট খোলা হোক বা ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হাসপাতালগুলির পুনর্গঠন করাই হোক না কেন… চিন বিভিন্ন ধরনের সফট পাওয়ার ব্যবহার করছে। এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হল নেপালে সেই সব বাহ্যিক প্রভাব রোধ করা-সহ কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জন করা, যা আসলে চিনা স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। যেহেতু চিন তার সংস্কৃতি ও শিক্ষার সুযোগের প্রচার করে, এটি একটি উপকারী ও সহায়ক প্রতিবেশী হওয়ার একটি আখ্যানও নির্মাণ করে, যা নেপালে ভারতের চিরাচরিত ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সবশেষে, নেপালে চিনের সফট পাওয়ার কূটনীতি তার বৃহত্তর বৈদেশিক নীতির লক্ষ্যগুলির একটি বাস্তব প্রকাশ হিসাবে কাজ করে, যার লক্ষ্য শুধু মাত্র চিন-অধ্যুষিত এশিয়ার জন্য নয়, চিনা নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার জন্যও প্রযোজ্য।
শ্রুতি সাক্সেনা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ইন্টার্ন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.