Published on Jun 05, 2025 Updated 0 Hours ago

শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে দ্বীপদেশটির সম্পর্ক একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, যার ফলে দিল্লির কাছে কলম্বোর বাস্তবতা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারের বিদেশনীতি: ভারতের জন্য শিক্ষা

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমার দিসানায়েকে এবং তাঁর ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের জয় শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পট পরিবর্তন ঘটালেও তাঁর সরকারের বিদেশনীতি ধারাবাহিকতা অনুমানযোগ্যতা প্রদর্শন করেছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বিশেষ করে দুটি চালিকাশক্তির কথা মনে রাখা উচিত: বাস্তববাদ এবং দূরদর্শিতা। প্রথমটির অর্থ হল নয়াদিল্লিকে শ্রীলঙ্কার মূল স্বার্থ সম্পর্কে তার বোধগম্যতা বিকাশ অব্যাহত রাখতে হবে এবং হিসেবি সম্পৃক্ততার পথে হাঁটতে হবেঅন্য দিকে দূরদর্শিতার বিষয়টি দুটি দেশের মধ্যে সাযুজ্য আনার জন্য ভিত্তি প্রদান করতে পারে।

বাস্তববাদ

জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করে, দিসানায়েকে এমন একটি বিদেশনীতি অনুসরণ করতে পারেন বলে মনে হচ্ছে। এনপিপি-র বাস্তববাদ গত দুই দশক ধরে কলম্বোর বিদেশনীতির বাস্তববাদী ভিত্তি বজায় রাখার অভিপ্রায়কেই দর্শায়। দলটির নেতারা বলেছেন যে, শ্রীলঙ্কার কোনও একটি বিদেশি অংশীদারের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করা উচিত নয় অর্থাৎ ভারতের মতো দেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য বাস্তববাদী কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে

এনপিপি-র বাস্তববাদ গত দুই দশক ধরে কলম্বোর বিদেশনীতির বাস্তববাদী ভিত্তি বজায় রাখার অভিপ্রায়কেই দর্শায়।

জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) প্রাথমিক বছরগুলি থেকে  উল্লেখযোগ্য রকম সরে এসেছে, যেখানে তারা শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে আংশিক ভাবে বিপ্লবের চেষ্টা করেছিল। তবে নতুন সরকার নয়াদিল্লির প্রতি একটি বাস্তববাদী মনোভাব পোষণ করেছে। নির্বাচনী প্রচারের সময় এনপিপি কোনও ভারতবিরোধী বক্তব্য পেশ করেনিবরং তারা বিষয়ভিত্তিক স্বার্থ সাধনে সম্পৃক্ত ছিল। নির্বাচিত হওয়ার আগেও দিসানায়েকে মোদী সরকারের আমন্ত্রণে দিল্লি সফর করেছিলেন এবং বিদেশমন্ত্রী (ইএএম) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাকরেছিলেন। একই ভাবে ভারতের বিদেশমন্ত্রী কলম্বো সফর করেছিলেন। সাধারণ নির্বাচনের পরে ভারত ছিল দিসানায়েকের প্রথম গন্তব্য। দিসানায়েকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তী কালে দুই দেশের মধ্যে পাইপলাইন সংক্রান্ত জ্বালানি বাণিজ্য বিনিয়োগের কথা বলা হয়।

তবে বাস্তবতাও বাঁকবদল করতে পারে। দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে আদানির পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প পর্যালোচনা করার এনপিপি-র সিদ্ধান্ত - যা শেষ পর্যন্ত আদানিকে শ্রীলঙ্কা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করে –ছিল আসলে চড়া মূল্য এড়িয়ে জাতীয় স্বার্থ অনুসরণ করার প্রয়াস

ভারত যদি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তার কৌশলগত স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তা হলে ভারতকে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। দুই রাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করলেও এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা চুক্তিগুলি অব্যাহত থাকলেও ভারত আসলে শ্রীলঙ্কার জন্য আপেক্ষিক সুবিধা প্রদানকারী হওয়ার দরুন সমালোচিত হয়েছে। দ্বীপের উত্তর উপকূলে মাছ ধরার বিষয়ে শ্রীলঙ্কার উদ্বেগগুলির সমাধান করে দিল্লি শ্রীলঙ্কার জনমানসে নিজের আস্থা বৃদ্ধি করতে পারে। সর্বোপরি, ভারতের তামিলনাড়ুর রাজনীতিবিদদের তরফে আসা চাপ প্রতিরোধ করা উচিত এবং প্রদেশগুলিতে কর্তৃত্ব বণ্টনের মতো বিষয়গুলিতে সম্পৃক্ত হওয়ার সময় আরও বেশি সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করা উচিত। অর্থনৈতিক ভাবে কলম্বো বিনিয়োগ, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সহায়তা থেকে লাভবান হলেও রাম সেতুর মাধ্যমে দুটি দেশকে সংযুক্তকারী সেতুর মতো প্রকল্পগুলিকে আঞ্চলিক স্থানীয় স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখেই শুরু করা উচিত।

দূরদর্শিতা

শ্রীলঙ্কার ভোটারদের এনপিপি-র প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বামপন্থী আদর্শগত বিশুদ্ধতার কারণেই সরকারের বাস্তববাদ সম্ভবত বামপন্থার দিকে ঝুঁকবে এবং জাতীয় স্বার্থকে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ দরিদ্রদের স্বার্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হবে। গত নির্বাচনে এনপিপি-র উপর আস্থা রাখা শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের বৃহত্তর জোটের সমর্থন বজায় রাখার জন্য বামপন্থী, জনগণের প্রতি আনুগত্য অপরিহার্য হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেলআউট অস্টারিটি প্যাকেজের মূল শর্তাবলি অনুসরণ করার জন্য সম্প্রতি বামপন্থীদের তরফে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে জোটের গণতান্ত্রিক নীতির অর্থ হল সরকার মধ্যমেয়াদে নীতি সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য জনসাধারণের অসন্তোষ উপেক্ষা করবে না।

এনপিপি ভারতের সঙ্গে কিছু চুক্তি পুনর্বিবেচনার জন্য সমর্থনকারী ভোটারদের তরফেও চাপের সম্মুখীন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সহযোগী বামপন্থী দল এবং জেভিপি-র বিচ্ছিন্ন অংশ - ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টি ত্রিনকোমালিকে একটি ভারতীয় অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রূপান্তর এবং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি বা ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনোলজি কোঅপারেশন এগ্রিমেন্টের (ইটিসিএ) সমালোচনা করেছে।

জোটের গণতান্ত্রিক নীতির অর্থ হল সরকার মধ্যমেয়াদে নীতি সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য জনসাধারণের অসন্তোষ উপেক্ষা করবে না।

তা সত্ত্বেও, এনপিপি-র মূল্যবোধ থেকে ভারত উপকৃত হচ্ছে কি না, তা বিশ্ব সংক্রান্ত দূরদর্শিতার প্রশ্ন উত্থাপন করে। শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আদর্শে বিশ্বাসী। এটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিদেশনীতির একটি স্তম্ভ হয়ে উঠলেও এনপিপি-র অধীনে তা আরও দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা প্রায়শই পশ্চিমি বা ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রগুলি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বহু-মেরুকৃত বিশ্বব্যবস্থার সমান্তরালে এগিয়েছে। এই অগ্রাধিকার ভারতের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিরও কেন্দ্রীয় বিষয়।

একটি প্রধান শক্তি হিসেবে বহু-মেরুত্বকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতের প্রচেষ্টার উপর জোর দিয়ে নয়াদিল্লি এনপিপি সরকার তার জনভিত্তির কাছে আবেদন জানাতে পারে। এই প্রচেষ্টার মধ্যে সামরিক পদক্ষেপ থেকে শুরু করে গাজা ইউক্রেনের মতো প্রধান বৈশ্বিক সংঘাতের ক্ষেত্রে অবস্থান, রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোট এবং কূটনৈতিক বক্তব্য পেশ করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চিনের সম্পর্কের প্রতি ভারতের মনোযোগ। এখনও পর্যন্ত চিনের উত্থান কলম্বোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ভারতকে আরও সহনশীল হতে এবং শ্রীলঙ্কাকে আরও বেশি করে উপঢৌকন দিতে বাধ্য করেছেতবে এই পরিস্থিতি ভারতকে তার শক্তি প্রদর্শনেও বাধ্য করেছে। চিনা কার্যকলাপের বিষয়ে দিল্লির উদ্বেগের কারণে শ্রীলঙ্কার সামুদ্রিক শেলফ (সমুদ্রে নিমজ্জিত দেশের কোনও অংশবিশেষ) সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ভারতের বিরোধিতা একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। জাফনা দ্বীপপুঞ্জের মিশ্র পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প - যা প্রাথমিক ভাবে গোতাবায়া রাজাপক্ষের রাষ্ট্রপতিত্বের সময় একটি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিনা সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল - ভারতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাতিল করা হয়েছিল এবং পরবর্তী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিংহের অধীনে অনুদানের আওতায় ভারতকে প্রকল্পটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

প্রতিবেশের হুমকি থেকে মনোযোগ সরিয়ে এনে যদি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে না থেকে ভারত বিশ্বব্যাপী নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করে, তা হলে তা আরও উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যখন দিল্লি রাশিয়ার উপর আরোপিত পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞাগুলিতে যোগদান করার বিষয়টির দৃঢ় বিরোধিতা করেছিল, তখন ভারত ও চিসম্পৃক্ততার পথে হেঁটেছিল এবং এ বিষয়ে মস্কোকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলচিনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ককে মেনে নেওয়া চিন-ভারত আস্থা তৈরির পদক্ষেপের অংশ হতে পারে। বহুমেরুকরণের বিষয়ে ভারতের অগ্রাধিকার লাভজনক হবে  যদি ভারত বর্তমান আধিপত্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকে, অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চিনের সম্পর্ককে প্রতিহত করে। প্রতিবেশের হুমকি থেকে মনোযোগ সরিয়ে এনে যদি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে না থেকে ভারত বিশ্বব্যাপী নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করে, তা হলে তা আরও উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি হবে। এটি শ্রীলঙ্কার জনমানসে ভারতের ভাবমূর্তিও রক্ষা করবে। কারণ ভারতীয় জনসাধারণের মতোই শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ কোনও দেশের ক্ষমতার আধিপত্য প্রকাশের ধারণায় ক্ষোভ প্রকাশ করে, যাদের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিল। সর্বোপরি, শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি মানুষজন এখনও অস্ত্রের মাধ্যমে বেজিংয়ের সমর্থনের মুখাপেক্ষী, যা এশিয়ার দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধের অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

পসংহার

গৃহযুদ্ধের আগেও শ্রীলঙ্কাকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিময় দ্বীপরাষ্ট্রগুলির অন্যতম বলে মনে করা হত। যদি দিসানায়েকে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জাতীয় স্বার্থ, দলের মৌলিক মূল্যবোধ এবং জনসাধারণের ইচ্ছা এই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে সর্বোত্তম ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন, তা হলে তিনি শ্রীলঙ্কার জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন। এনপিপি-র সমাজতান্ত্রিক শিকড় কী ভাবে তাদের পছন্দ এবং নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ধারণাকে পরিচালিত করতে পারে, তা বোঝা এবং বিষয়টিকে সম্মান করা নয়াদিল্লির জন্য কলম্বোর সঙ্গে ইতিবাচক ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, শ্রীলঙ্কার বহু-মেরুকৃত বিশ্বব্যবস্থার মনোভাবের প্রতি আবেদন এনপিপি শ্রীলঙ্কার জনগণের কাছে ভারতকে প্রিয়পাত্র করে তুলতে পারে। এটি ভারতের বৈশ্বিক শক্তির মর্যাদায় পৌঁছনোর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং দিল্লির একটি ন্যায্য, বহু-মেরুকৃত বিশ্বের লক্ষ্যকে সমর্থন জোগাতে সাহায্য করবে।

 


কেদিরা পেথিয়াগোড়া ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, প্রাক্তন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং কূটনীতিক।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.