Image Source: Getty
কুড়িটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং ৩৬টি প্রতিনিধিদল অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে কাজানে ১৬তম ব্রিকস সম্মেলনের সূচনা করেন, যা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট গোষ্ঠীটির গত বছর সম্প্রসারণের পর - যখন সৌদি আরব, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে (ইউএই) সংগঠনের সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল – থেকে এই প্রথম সম্মেলন। উদীয়মান অর্থনীতির এই বহুপাক্ষিক জোট বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৫%-এর বেশি ও বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি প্রতিনিধিত্ব করে। আরও সম্প্রসারণের সম্ভাবনা এবং একটি বিভাজিত ভূ-অর্থনৈতিক ক্রম যে তাদের চাহিদা পূরণ করছে না… সে বিষয়ে উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে অসন্তোষের প্রেক্ষিতে ব্রিকসের আন্তর্জাতিক মান্যতা বৃদ্ধিই পেয়েছে। ব্রিকসের এই বছরের ভাবনা ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য বহুপাক্ষিকতার সশক্তিকরণ’ এই বাস্তবতাকে দর্শিয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান শুল্ক, সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ এবং পশ্চিম ও তার মিত্রদের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞার আলোকে আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনৈতিক পরিসরের পরিবর্তনের ফলে ব্রিকসের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশগুলির জন্য একটি অন্যতম আকর্ষণীয় প্রেক্ষিত হয়ে থেকেছে এই বাস্তবতা যে, ব্রিকস একটি প্রধান অ-পশ্চিমী মঞ্চ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এটিকে আরও গণতান্ত্রিক কাঠামো হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ গোষ্ঠীটি অ-পশ্চিমী শক্তিগুলির একটি জোট হয়ে উঠছে, যার লক্ষ্য হল বহুমেরুকরণ ও সহজে প্রবেশাধিকারযোগ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রচার চালানো। এ ছাড়াও, সংস্থাটির স্থিতিস্থাপকতা আর একটি আকর্ষণের বিষয়, যা সদস্যপদের জন্য কোনও পূর্বশর্ত চাপিয়ে দেয় না। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, আরও ৩০টি দেশ এই জোটে যোগ দিতে চায়। ভারতের জন্য ব্রিকস হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বহুপাক্ষিক জোট। কারণ এটি নয়াদিল্লির বহুমুখী বিশ্বদর্শনকে প্রতিফলিত করে এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাজান সফর ভারতের বিদেশনীতির সমীকরণে ব্রিকসের গুরুত্বকেই দর্শায়।
বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান শুল্ক, সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ এবং পশ্চিম ও তার মিত্রদের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞার আলোকে আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনৈতিক পরিসরের পরিবর্তনের ফলে ব্রিকসের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারত তার অগ্রাধিকার অনুযায়ী ব্রিকসের কর্মসূচি এবং ফলাফলকে আকার দিয়ে এসেছে। ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলি-সহ ভারত তার সমস্ত শক্তি এমন কোনও মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায় না, যেটি শুধুমাত্র পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল এবং ভারত চায় যে, তার বৈদেশিক নীতি পছন্দগুলি যেন তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ও বহুমেরুকরণের মূল নীতি দ্বারা আকার পায়, যার জন্য ব্রিকস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সমস্যার নিরিখে তাদের ভারসাম্যমূলক অবস্থানের দরুন দেশগুলি এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে সমর্থ হয়েছে যে, ব্রিকস একটি পশ্চিম-বিরোধী সংগঠন। বরং দেশগুলি জলবায়ু সঙ্কট, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সাম্যের মতো বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে গ্লোবাল সাউথের স্বর ও স্বার্থকে সংগঠনটির মনোযোগের আওতায় নিয়ে এসেছে।
সর্বোপরি ভারত অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা, সন্ত্রাস দমন, দুর্নীতি দমন ও আইসিটি-র ব্যবহারে নিরাপত্তার মতো বিষয়ে ব্রিকসের সহযোগিতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ব্রিকসের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ভারত এমন সমমনস্ক দেশ খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেখে। এ হেন দেশের মধ্যে রয়েছে মিশর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। ভারতের মতোই এই সমস্ত দেশও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অংশ হয়ে ওঠেনি এবং একই সঙ্গে তারা রাশিয়া ও চিনের মতো সম্পূর্ণ অ-ডলারিকরণের পক্ষেও মত দেয়নি। নয়াদিল্লির পাশাপাশি এই দেশগুলিও তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিসরে নিজ নিজ মুদ্রার সশক্তিকরণ করতে চায়।
এই শীর্ষ সম্মেলনটি কাজান ডিক্লেয়ারেশন শীর্ষক একটি ১৩৪ দফার একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল, যেখানে একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার প্রচারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে উন্নত করার ডাক দেওয়া হয়েছে এবং যেখানে গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বরকে জোরদার করা হয়েছে। সর্বোপরি, ২০২৮ সালে কপ৩৩-এ ভারতের পদপ্রার্থী হওয়াকে স্বাগত জানানো হয়েছে। ভারতের ব্রিকস-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগগুলি অর্থাৎ ব্রিকস আরঅ্যান্ডডি ভ্যাকসিন সেন্টার, ব্রিকস স্টার্ট-আপ ফোরাম এবং ব্রিকস কাউন্টার-টেররিজম অ্যাকশন প্ল্যান বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছে।
ব্রিকসের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ভারত এমন সমমনস্ক দেশ খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেখে। এ হেন দেশের মধ্যে রয়েছে মিশর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি।
ডিক্লেয়ারেশনে রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে অন্তর্ভুক্ত নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সন্ত্রাসবাদের হুমকি প্রতিরোধ ও দমনে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে এটিতে সন্ত্রাসীদের আন্তঃসীমান্ত চলাচলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ দ্বারা চিহ্নিত সমস্ত সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে তালিকাভুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও ডিজিটাল জনঅবকাঠামো ও পরিবহণ পরিকাঠামোর উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, যেখানে প্রথম বারের মতো পরিবহণের সম্ভাব্য অবকাঠামো বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রশ্নের উল্লেখ ঘোষণায় করা হয়েছে।
নয়াদিল্লির জন্য ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া্র জরুরি মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে প্রাসঙ্গিক দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেমন রুশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবশিষ্ট ভারতীয় নাগরিকদের প্রত্যাবাসন, কুদানকুলাম পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে অবশিষ্ট পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের কাজটি ত্বরান্বিত করা, আর্থিক ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতা এবং কয়লা ও সার আমদানির জন্য সরবরাহ শৃঙ্খলগুলিকে স্থিতিশীল করে তোলা। প্রধানমন্ত্রী মোদী ইউক্রেনের সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারতের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়াও মোদী ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গেও দেখা করেন এবং সংযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে চাবাহার বন্দর সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করেন।
চিন-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রাক-গালওয়ান স্থিতাবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশার পাশাপাশি মোদী বলেছেন যে, সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতা ভারত-চিন সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত।
সর্বোপরি এবং সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল পাঁচ বছরের বিরতির পরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর টহলদারি সংক্রান্ত দুই দেশের একটি চুক্তিতে পৌঁছনোর প্রেক্ষিতে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাক্ষাৎ। চিন-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রাক-গালওয়ান স্থিতাবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশার পাশাপাশি মোদী বলেছেন যে, সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতা ভারত-চিন সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত।
সকল অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত যখন বৃহত্তর ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমেছে, তখন ব্রিকসের মতো মঞ্চগুলি নয়াদিল্লিকে তার মর্যাদাকে বহু গুণ বৃদ্ধি করতে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজোটে কাজ করার সুযোগ করে দেয়।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.