২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে বিমান হামলা শুরু করেছিল। তখন কেউ কল্পনাও করেনি যে, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হবে এবং যুদ্ধটি এত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। তবুও এই ঘটনার দুই বছরেরও বেশি সময় পরে এই যুদ্ধের ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত রয়েছে। দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রভাব আফ্রিকা জুড়ে গভীর ভাবে অনুভূত হয়েছে, যা মহাদেশটির খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে একটি সাত-সদস্যের আফ্রিকান শান্তি প্রতিনিধিদল ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের অবসান ঘটাতে দুই নেতাকে রাজি করানোর উদ্দেশ্যে রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয় দেশই সফর করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য দেশের অনেক শান্তি উদ্যোগের প্রস্তাবের মতোই এই প্রচেষ্টাটিও ব্যর্থ হয়। কারণ কোনও নেতাই আলাপ-আলোচনায় রাজি হননি।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতোই কিয়েভ এবং মস্কোর মধ্যে যুদ্ধ সাহেলেও ছড়িয়ে পড়েছে, যা ঠান্ডা লড়াইয়ের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা উভয় দেশকে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করতে চালিত করে। এর ফলে অসংখ্য সংঘর্ষ এবং এমনকি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধও হয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এবং মহাদেশ জুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রসার ঘটে। একগুচ্ছ চাপানউতোরের ঘটনাপ্রবাহের মাঝেই মনে হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে একটি নতুন ফ্রন্ট এখন আফ্রিকার সাহেলে পুনরুত্থিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা উভয় দেশকে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করতে চালিত করে।
সম্প্রতি উত্তর মালিতে একটি অতর্কিত বিদ্রোহী হামলায় ৮৪ জন রাশিয়ান ওয়াগনার ভাড়াটে যোদ্ধা এবং ৪৭ জন মালিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছে। ২২ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত মালিয়ান সামরিক বাহিনী এবং ওয়াগনার গোষ্ঠী আলজেরিয়ার সীমান্তের নিকটবর্তী টিনজাউয়াতেনের কাছে তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জিহাদি জঙ্গিদের জোটের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অচলাবস্থার শেষ কয়েক দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারী অস্ত্র, ড্রোন এবং আত্মঘাতী গাড়ি বোমা (এসভিবিআইইডি) ব্যবহার করে তাদের আক্রমণ তীব্রতর করে তোলে, যার ফলে ওয়াগনার ভাড়াটে যোদ্ধা এবং মালিয়ান সৈন্য উভয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী এই যুদ্ধে বুদ্ধিমত্তা প্রদানের কথা এবং সম্ভবত ওয়াগনার এবং মালিয়ান হুন্তার সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে কিছু অস্ত্র সরবরাহের কথাও স্বীকার করে নিয়েছে।
পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ মালি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তার উত্তরাঞ্চলে এই বিদ্রোহী জিহাদি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০১৩ সাল থেকে ফ্রান্স এই লড়াইয়ে মালিয়ান সরকারকে সহায়তা করে আসছে। যাই হোক, ২০২০ সালে মালিতে সামরিক হুন্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর ফ্রান্স নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং ইকোনমিক কমিউনিটি অফ ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস (ইকোওয়াস) মালির উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, হুন্তা ফরাসি বাহিনীকে সে দেশ থেকে বহিষ্কার করে এবং ইকোওয়াস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এর পর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে সমর্থনের জন্য রাশিয়ার ব্যক্তিগত সামরিক গোষ্ঠী ওয়াগনারের সঙ্গে হাত মেলায় তারা।
পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ মালি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তার উত্তরাঞ্চলে এই বিদ্রোহী জিহাদি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে লড়াই করছে।
এই ধাক্কাটি রাশিয়ার জন্য আফ্রিকায় পুনঃনিযুক্তির পর থেকে যুক্তিযুক্ত ভাবে তীব্র। লক্ষ্যণীয়ভাবে, এই একক ঘটনার ফলে রুশ হতাহতের সংখ্যা ন’বছর ব্যাপী নজরদারির সময়কালে ফরাসি হতাহতের ঘটনার চেয়ে বেশি। এর জবাবে মালি ইউক্রেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। মালির উত্তরের প্রতিবেশী নাইজারও একই পথে হেঁটেছে এবং আফ্রিকার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। লিপতাকো-গৌরমা সনদের তৃতীয় স্বাক্ষরকারী এবং অ্যালায়েন্স অফ সাহেল স্টেটসের সদস্য বুরকিনা ফাসো ইউক্রেনের সঙ্গে তার কূটনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করতে পারে। এর আগে, ইউক্রেন সুদানের গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকা এবং সুদান সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর (আরএসএফ) সমর্থন নিশ্চিত করেছিল। আরএসএফ-এর নেতৃত্বে রয়েছেন জেনারেল মুহাম্মদ হামদান হেমেদতি দাগালো, যিনি কথিত ভাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি দ্বারা সমর্থিত। আর অন্য দিকে এসএএফ-এর নেতৃত্বে আছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং বর্তমানে ওয়াগনার গ্রুপ দ্বারা সমর্থিত। সুদানও ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই কূটনৈতিক বচসা ইউক্রেনকে খুব বেশি প্রভাবিত না করলেও এটি ইউক্রেনের জন্য একটি প্রতীকী হার। ইউক্রেনের আখ্যানকে শক্তিশালী করা এবং প্রচারমূলক বিজয় পাওয়ার পরিবর্তে এই পুরো পর্বটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধেই কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।
হার মানতে অস্বীকার করার পরিবর্তে ইউক্রেন ওয়াগনারের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের তাৎপর্য বৃদ্ধি করার জন্য নিজের আখ্যানের প্রচারকে আরও জোরদার করেছে। সাহেলে কূটনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও ইউক্রেনের ফরেন মিনিস্টার দিমিত্রো কুলেবা আফ্রিকায় তাঁর তিন-দেশের সফর বজায় রেখেছেন, যেখানে তিনি মালাউই, জাম্বিয়া এবং মরিশাস সফর করবেন। তিনটি দেশই ইউএনজিএ রেজোলিউশনের সময় রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করে ভোট দিয়েছে। এটি একটি বিল, যা আফ্রিকার ২৪টি দেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। যেহেতু ইউক্রেনের ফরেন মিনিস্টার দুই বছরের মধ্যে মহাদেশে তাঁর চতুর্থ সফর করবেন, এটি ইউক্রেনের জন্য আফ্রিকার কৌশলগত গুরুত্বকেই দর্শায়। উপরন্তু, ইউক্রেন জুন মাসে সুইজারল্যান্ডে একটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। আফ্রিকা থেকে সমর্থন কিছুটা ক্ষীণ হলেও আফ্রিকার ৫৫টি দেশের মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং ইউক্রেন মহাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার পরিকল্পনা করেছে।
সাহেলে কূটনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও ইউক্রেনের ফরেন মিনিস্টার দিমিত্রো কুলেবা আফ্রিকায় তাঁর তিন-দেশের সফর বজায় রেখেছেন, যেখানে তিনি মালাউই, জাম্বিয়া এবং মরিশাস সফর করবেন।
অন্য দিকে, এই অতর্কিত হামলা ওয়াগনার গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলে দিলেও এবং এর ফলে গোষ্ঠীটির উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও, এমনটা প্রায় অসম্ভব যে, ওয়াগনার মালি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে। ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই মালি ও প্রতিবেশী নাইজার থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে এবং এটি রাশিয়ার জন্য তার প্রভাবের বৃত্ত প্রসারিত করার একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। বর্তমানে, মালিতে ওয়াগনারের প্রায় ১০০০ জন সৈন্য রয়েছে। প্রায় দ্বিগুণ সৈন্য থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্স জিহাদি দলগুলিকে দমন করতে পারেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে, রাশিয়া মালিতে তার শক্তি বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করতে পারে, যদি হুন্তা সে খরচ বহন করতে সক্ষম হয়। যাই হোক, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং সুদানের বিপরীতে - যেখানে ওয়াগনার বা তার উত্তরসূরি আফ্রিকা কোর সক্রিয় রয়েছে - মালির সম্পদ সীমিত এবং হুন্তা সরকারের পক্ষে এই বাহিনীর খরচ জোগানো সহজ নয়।
সামনের পথ
এই একটি পরাজয় রাশিয়াকে মালি পরিত্যাগ করতে এবং আফ্রিকা থেকে ওয়াগনার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করবে না। এমনটা মোজাম্বিকেও ঘটেছে, যেখানে বেশ কয়েকজন ওয়াগনার সদস্য জিহাদিদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে মারা যান। যাই হোক, উত্তর মালিতে সংঘাত বাড়তে থাকলে তা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা ইতিমধ্যেই অস্থির অঞ্চলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গোপন সমর্থন পেয়ে বা তা ছাড়া ইউক্রেন রাশিয়া বিরোধী ফ্রন্টকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর, মালির বর্তমান শাসক এবং অন্য অনেক আফ্রিকান দেশের কাছে বিকল্পের সংখ্যা সীমিত। অতএব, এই দেশগুলির মধ্যে কেউই রাশিয়ার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে পারবে না। পরিবর্তে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে, রাশিয়া আফ্রিকায় তার সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করার কথা বিবেচনা করতে পারে।
সমীর ভট্টাচার্য অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.