Author : Hari Bansh Jha

Published on May 22, 2024 Updated 0 Hours ago

নেপাল থেকে বহু সংখ্যক মানুষের ক্রমাগত প্রস্থান নেপালের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।

নেপাল থেকে প্রস্থান

নেপালে ২০২১ সালে পরিচালিত সর্বশেষ আদমশুমারিতে দেখা গিয়েছে যে, দেশের জনসংখ্যার গড় বৃদ্ধি ২০১১ সালের ১.৩৪ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ০.৯৩ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। জনসংখ্যার প্রস্থান বা বহির্গমন, প্রজনন হার হ্রাস, প্রধানত অল্পবয়সি মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় কর্মশক্তিতে দম্পতিদের বৃহত্তর সম্পৃক্ততা এ হেন পরিবর্তনকে চালিত করেছে। জনসংখ্যার বহির্গমনের কারণে দেশটি প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স বা প্রেরিত অর্থের সুবিধা অর্জন করে, যা আবার দ্রুতই তলানিতে এসে ঠেকে। কারণ নেপাল সূচ থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মতো বেশির ভাগ পণ্য আমদানি করে বিদেশ থেকে।

নেপালে মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের সুযোগ আয়ের অভাবে যুবকরা দলে দলে দেশ ছাড়ছেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে মাত্র ২১৫৯ জন মানুষ বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য নেপাল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই পরিসংখ্যান ২০০৬-০৭ সালে বেড়ে ২১৪০৯৪ এবং ২০২২-২৩ সালে বেড়ে ৭৫০০০০-দাঁড়িয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার যুবক-যুবতী বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য নেপাল ছেড়ে উপসাগরীয় দেশ, মালয়েশিয়া, ইউরোপ-সহ বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। নেপালের মোট ৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ দেশ ত্যাগ করে

 

গ্রামীণ এলাকায় বসতি স্থাপনকারী মানুষ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং বসতির বিস্তৃত অংশ শুধু মাত্র ভুতুড়ে গ্রাম বা জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে।

 

দেশের বহু মানুষ চাকরি এবং উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার মতো অন্যান্য মৌলিক সুযোগের সন্ধানে ধীরে ধীরে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরে চলে যাচ্ছে। অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার মান জনগণের জন্য যে স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। ফলে গ্রামগুলি শুধু মাত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে না, দ্রুত জনহীন হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ এলাকায় বসতি স্থাপনকারী মানুষ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং বসতির বিস্তৃত অংশ শুধু মাত্র ভুতুড়ে গ্রাম বা জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, নেপালের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ এখন গ্রামীণ এলাকায় বাস করেন, যেখানে দুই তৃতীয়াংশ বাস করেন শহরাঞ্চলে। পাহাড়ি ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী গ্রামবাসীরাও বাস্তুভিটে ত্যাগ করছেন এবং ভারতের সীমান্তবর্তী তরাই অঞ্চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করছে। এর ফলে তরাই অঞ্চলের জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়ে নেপালের সমগ্র জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যদিও আয়তনের নিরিখে এই অঞ্চলটি দেশের মোট ভূখণ্ডের মাত্র ২৩ শতাংশ জুড়ে রয়েছে।

জনসংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, নেপাল একটি পাহাড় অধ্যুষিত দেশ থেকে তরাই বা মাধেশ অধ্যুষিত দেশে পরিণত হয়েছে, যা সমস্ত ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেজনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনও স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। বিশেষ করে পার্বত্য ও পাহাড়ি অঞ্চলে এ হেন পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে যে, কার্যত উন্নয়নের ফল এবং সরকারি সংস্থাগুলি দ্বারা তাঁদের বাড়ির দুয়ারে প্রদত্ত অন্যান্য মৌলিক পরিষেবা ভোগ করার জন্য অনেক গ্রামেই খুব কম সংখ্যক মানুষই অবশিষ্ট রয়েছেন।

দেশের জনহীন গ্রাম সম্পর্কে কাঠমান্ডুর ট্যাক্সিচালক গণেশ কর্ণ বলেছেন, ‘যদি দেশত্যাগের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তা হলে তা দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।ললিতপুরের এক ব্যবসায়ী সুমন খাডকা বলেছেন, ‘দেশত্যাগ নিয়ন্ত্রণ না করলে নেপাল একটি দেশ হিসেবে আদৌ আর টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ভক্তপুরের স্কুল সংলগ্ন দোকানদার রামপ্রসাদ মহারজান বলেন, ‘নেপালে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিয়ে সরকার বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। গ্রামের পর গ্রাম শূন্য হয়ে যাওয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় একটি সক্রিয় সরকার প্রয়োজন।’

 

বিশেষ করে পার্বত্য ও পাহাড়ি অঞ্চলে এ হেন পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে যে, কার্যত উন্নয়নের ফল এবং সরকারি সংস্থাগুলি দ্বারা তাঁদের বাড়ির দুয়ারে প্রদত্ত অন্যান্য মৌলিক পরিষেবা ভোগ করার জন্য অনেক গ্রামেই খুব কম সংখ্যক মানুষই অবশিষ্ট রয়েছেন।

 

গ্রামগুলি যে ভাবে জনশূন্য হয়ে পড়ছে, তা নিয়ে নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল অত্যন্ত উদ্বিগ্ন গ্রামগুলিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলা সত্ত্বেও সেগুলি কেন এ ভাবে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে তিনি যারপরনাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কাঠমান্ডুতে সরস্বতী মাল্টিপল ক্যাম্পাসের ৬৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সভাপতি পাউডেল বলেন, ‘গণতন্ত্রের পর দেশের শিক্ষা, যোগাযোগ, রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য ও বিদ্যু্দয়নের উন্নয়ন সত্ত্বেও আজ গ্রামগুলির এই অবস্থা কেন? কেন লোকের অভাবে গ্রামগুলি ধুঁকছে?’ অন্য একটি অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিদেশের প্রতি ভালোবাসায় মত্ত, সেখানে আমরা সুযোগের সন্ধানে ছুটে চলেছি, যখন আমাদের নিজের দেশে সেই সুযোগ উপলব্ধ রয়েছে। এত কিছুর পরেও এমন হাল কেন? আমি নিজেকে এই প্রশ্ন করি এবং এই উত্তরও আমার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। সব কিছুই গ্রামে পৌঁছচ্ছে, কিন্তু গ্রামে উপযুক্ত কর্মসংস্থান জীবিকা নির্বাহের পরিস্থিতি ভাল নয়।

জনসংখ্যার কারণে অনেক স্কুল শুধু গ্রামেই নয় কাঠমান্ডুর মতো একটি মেট্রোপলিটন রাজধানী শহরেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কর্নালির মতো একটি প্রত্যন্ত প্রদেশে ৩০ শতাংশেরও বেশি সরকারি স্কুলে ভর্তির সংখ্যা কম হওয়ার কারণে সেগুলি টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার স্কুল শিক্ষার খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে এবং শিক্ষার্থী না থাকা সত্ত্বেও স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষকদের বেতন প্রদান করা হচ্ছে।

জনসংখ্যা সারা দেশে ভোগপণ্য সংক্রান্ত আচরণকেও প্রভাবিত করেছে। দেশে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা কম থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এবং বেসরকারি দুগ্ধ সংস্থাগুলি কৃষকদের কোটি কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ করতে অসুবিধায় পড়ছে। সেই হতাশায় অনেক কৃষক আন্দোলন শুরু করেছেন এবং আক্ষরিক অর্থে মূল্যবান দুধ নর্দমায় ঢেলে দিচ্ছেন। এ ছাড়া দেশের অধিকাংশ রেস্তোরাঁয় ক্রেতার দেখা মিলছে না বললেই চলে। কাঠমান্ডু উপত্যকায় রেস্তোঁরাগুলিতে মানুষের সংখ্যা প্রাক্‌-অতিমারি পর্যায়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়াও গ্রাহক সংখ্যা কমে যাওয়ায় পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানিও কমেছে।

 

দেশে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা কম থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এবং বেসরকারি দুগ্ধ সংস্থাগুলি কৃষকদের কোটি কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ করতে অসুবিধায় পড়ছে।

 

জনসংখ্যার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন ভারসাম্যহীনতা সত্ত্বেও দেশটি ২০২২-২৩ সালে ৯.৩৩  বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে, যা নেপালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক চতুর্থাংশ। ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে এবং এই পরিমাণ বছরের শেষ নাগাদ দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অর্জিত রেমিট্যান্স বা বিদেশি অর্থ উৎপাদন খাতে খুব কমই ব্যবহৃত হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোগের কাজে ফুরিয়ে যায়।

কার্যত, নেপাল জাতীয় স্বার্থে নয়, বরং পশ্চিম ও পারস্য উপসাগরের স্বার্থে সস্তা অদক্ষ শ্রম উৎপাদন করছে এ ভাবে গ্রামগুলি ক্রমশ জনশূন্য হয়ে পড়ছে এবং মারাত্মক আকারের আর্থ-সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। এটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য মোটেও শুভ নয়। এই অবস্থার মোড় ঘোরাতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল, কৃষি বিপ্লবের উপর মনোনিবেশ করা এবং ব্যাপক হারে লাভজনক কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি পণ্য ও পরিষেবাগুলির অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধি করার জন্য গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা, দক্ষতা, পর্যটন শক্তি বিকাশ করা।

 


হরি বংশ ঝা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.