প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারত ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭৫তম বার্ষিকীর প্রেক্ষাপটে অস্ট্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে যান। এই সফরটি ঐতিহাসিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর (১৯৮৩ সালে) পর গত ৪১ বছরে মোদীই প্রথম ভারতীয় নেতা, যিনি এই নিরপেক্ষ দেশে সফর করেছেন। ভারত ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও তেমন ভাবে এই সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হয়নি। বিদেশমন্ত্রী ডাঃ এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল-সহ একটি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভিয়েনা সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গভীর ও বিস্তৃত করার দৃঢ় অভিপ্রায়কেই দর্শায়।
সফরের প্রধান দিকগুলি
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভিয়েনা সফরের প্রেক্ষিতে এ কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, মোদী ৩.০-র মন্ত্রিসভা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতারই প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং মন্ত্রিসভার প্রধান পদগুলিও অপরিবর্তিত রয়েছে। ধারাবাহিকতার চিহ্ন হিসাবে মোদী স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ এবং বিদেশ বিষয়ক ক্ষেত্রে তাঁর চার মন্ত্রীকেই ধরে রেখেছেন। অস্ট্রিয়ায় থাকার সময় মোদী একাধিক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ফন দের বেলেন এবং চ্যান্সেলর কার্ল নেহামারের সঙ্গে দেখা করেছেন। এর পাশাপাশি বিদেশমন্ত্রী শ্যালেনবার্গ এবং ব্যবসায়িক প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গেও দেখা করেন। সফরের আগে তাঁর বিবৃতিতে মোদী জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, অস্ট্রিয়া ভারতের একটি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার এবং উভয় দেশই গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের আদর্শকে ভাগ করে নেয়। উদ্ভাবন, প্রযুক্তি এবং স্থিতিশীল উন্নয়নের মতো আলোচনায় নতুন ক্ষেত্রের উপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। পারস্পরিক উপকারী অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভিয়েনা সফরের প্রেক্ষিতে এ কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, মোদী ৩.০-র মন্ত্রিসভা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতারই প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং মন্ত্রিসভার প্রধান পদগুলিও অপরিবর্তিত রয়েছে।
ভারত ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপরেও নজর দেওয়া হয়েছে। সেগুলির মধ্যে একটি প্রধান বিষয় হল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ এবং গ্লোবাল সাউথের উপর সেই যুদ্ধের ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব, বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ, মুদ্রাস্ফীতি ও শান্তি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে। চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গেই আফগানিস্তানে আইএসপিকে-র মতো সন্ত্রাসবাদী শৃঙ্খলের ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে আরও আলোচনা হয়েছে। ভারত ক্রমশ গ্লোবাল সাউথের সেই দেশগুলির হয়ে এক সওয়ালকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে, যে দেশগুলি ইউক্রেন যুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রভাব দ্বারা মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত এবং এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও হামলা বৃদ্ধির জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সম্ভাবনা
এই সফরের মূল লক্ষ্য হল অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করা। মোদী এবং নেহামার পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রকল্পের সুযোগ অন্বেষণ করতে অস্ট্রীয় শিল্প প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি অবকাঠামো এবং উত্পাদন শিল্পের ক্ষেত্রে অস্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
মোদী তাঁর নির্বাচনী প্রচারের সময় ভারতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের পরে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। জি২০ দেশগুলির মধ্যে ভারত বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, যার চিত্তাকর্ষক বৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রায় আট শতাংশ। এ ছাড়াও, ইউরোপের বিপরীতে ভারতের অত্যন্ত ইতিবাচক জনসংখ্যা রয়েছে এবং ১.৪ বিলিয়ন হওয়ার দরুন গত বছর সেই জনসংখ্যা চিনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ও ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে উঠে এসেছে। একই বছরে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে পঞ্চম স্থান থেকে গ্রেট ব্রিটেনকে সরিয়ে নিজের জায়গা পোক্ত করেছে।
এখন ইইউ-এর বাইরে অস্ট্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হিসাবে ভারতকে বিবেচনা করা হয়, যার বাণিজ্যের পরিমাণ ২.৭ বিলিয়ন ইউরো। ২০২৩ সালের শেষে ভারতে অস্ট্রিয়ার তরফে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭৩৩ মিলিয়ন ইউরো, যেখানে অস্ট্রিয়ায় ভারতীয় বিনিয়োগ সম্প্রতি ১.৬ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে। বিশেষ করে নতুন ইইউ কমিশনের ভূ-অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে - যেটি এই মেয়াদে ভারতের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী - আরও ব্যাপক বৃদ্ধির জন্য প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধরনের একটি চুক্তি শুধুমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ বাজারে ভারতের প্রবেশের সুবিধাই দেবে না, বরং অস্ট্রিয়া-সহ অনেক দেশে লক্ষ্যণীয় দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রিত শ্রম অভিবাসনের বিষয়ে আলোচনাকেও প্রসারিত করবে।
এখন ইইউ-এর বাইরে অস্ট্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হিসাবে ভারতকে বিবেচনা করা হয়, যার বাণিজ্যের পরিমাণ ২.৭ বিলিয়ন ইউরো। ২০২৩ সালের শেষে ভারতে অস্ট্রিয়ার তরফে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭৩৩ মিলিয়ন ইউরো, যেখানে অস্ট্রিয়ায় ভারতীয় বিনিয়োগ সম্প্রতি ১.৬ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে।
বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনীতি ও জ্বালানির গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা, উদীয়মান প্রযুক্তি ও ডিজিটালকরণ এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সবুজ হাইড্রোজেনের মতো বিষয়গুলি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে আলোচ্যসূচির একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে। ভারত সবুজ হাইড্রোজেনের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হওয়ার চেষ্টা করছে এবং সৌর শক্তিতেও প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। এ ছাড়াও দেশটি বিভিন্ন সংস্থা এবং মঞ্চে জড়িত রয়েছে। যেমন সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিস্থাপকতা ও পুনর্বিন্যাস, রেয়ার আর্থ ও ধাতুর পাশাপাশি জ্বালানি পরিবর্তন, ডিজিটালকরণ ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যগুলিতে প্রবেশাধিকার উন্নত করতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুর্পাক্ষিক বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ভারতে জি২০ সম্মেলনে ঘোষিত আইএমইসি করিডোর (ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডোর) সহ বেশ কয়েকটি পরিবহণ ও সংযোগ করিডোর বিকাশের পরিকল্পনা করছে। এই মাল্টিমোডাল বা বহুমুখী সমুদ্র ও স্থল করিডোর অস্ট্রীয় বাণিজ্যের জন্য, বিশেষ করে ভারত ও ইতালির মধ্যে সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে দারুণ সুযোগ দেয়। এর অর্থ হল, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোয় উল্লেখযোগ্য সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি কৃষি খাতে এবং উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও সুযোগ করে দেয়। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ২৫০০টি নতুন যাত্রীবাহী কোচ এবং ১০০০০ অতিরিক্ত মালবাহী ওয়াগনের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়াও ২০২৪ কেন্দ্রীয় বাজেটের আগে বহরের আধুনিকীকরণের জন্য ৫০টি নতুন অমৃত ভারত ট্রেন তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে অবকাঠামো প্রকল্পগুলিতে ভারত সরকারের ধারাবাহিক মনোযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রেলপথ এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রীয় সংস্থাগুলি অতীতে এই ক্ষেত্রগুলিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে এবং রেলওয়ে ও অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষেত্রের পাশাপাশি দূষণহীন এবং সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রেও একটি মূল্যবান অংশীদার হতে পারে। এই উত্তেজনাপূর্ণ উন্নয়নগুলি সবুজ প্রযুক্তি ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে এবং উদ্ভিদ প্রকৌশল, অটোমেশন, স্বয়ংচালিত ক্ষেত্র এবং পরিবহণ অবকাঠামোর মতো শিল্পের আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অস্ট্রীয় শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য সুযোগ ও বিকাশের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে। স্টার্টআপ এবং ডিজিটালকরণের মতো বিশেষ ক্ষেত্রগুলিও গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারত ইতিমধ্যেই সবচেয়ে বেশি ডিজিটাল লেনদেনের দেশ হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক নিষ্পত্তি ব্যবস্থার বিকাশের আলোকে আরও আলোচনা হতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির অধীনে উচ্চ মানের এবং সাশ্রয়ী উত্পাদনের জন্য ভারতের অর্থনৈতিক পরিসরকে কাজে লাগানোর বিষয়টি দেশটিকে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলের জন্য একটি প্রধান গন্তব্য হিসাবে জায়গা করে দিয়েছে, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারে পরিবেশন করতে সক্ষম। প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিম হল এমন একটি কৌশলগত উদ্যোগ যা অর্ধপরিবাহী, চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জাম এবং সোলার পিভি সেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিশ্ব উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিকে আকৃষ্ট করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে। অস্ট্রীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা-সহ ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি এবং দক্ষ কর্মশক্তির মধ্যে সমন্বয়, স্থিতিশীল ব্যবসা বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে।
মধ্যস্থতাকারী এবং সেতু নির্মাণকারী হিসেবে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা
এ কথাও বলা জরুরি যে, সম্প্রতি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চ্যান্সেলর নেহামারই একমাত্র ইইউ নেতা, যিনি মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। হাঙ্গেরির প্রাইম মিনিস্টার ভিক্টর অরবানের সাম্প্রতিক রাশিয়া সফর এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর চিনে আশ্চর্যজনক সফরের পাশাপাশি নেহামারের সফর আসলে ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক আকাঙ্ক্ষার একটি ভিন্ন সমঝোতাকেই দর্শায়, যা অবশ্য ইইউ সদস্য রাষ্ট্র এবং ইইউ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারত পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় শক্তি ব্লকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং বিকাশ করার ক্ষমতা-সহ আন্তর্জাতিক ও সঙ্কটপূর্ণ ক্ষেত্রে নিজেকে একটি ভূ-রাজনৈতিক সেতু বন্ধনকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ইউরোপের একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে অস্ট্রিয়া বারবার নিজেকে এই ভূমিকায় দেখতে চেয়েছে। তবে অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে অনুশীলনের ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক উন্মোচনের অভাব রয়েছে।
সাম্প্রতিক অতীতে, বিশেষ করে নয়াদিল্লিতে সাম্প্রতিক জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারত বিশ্ব মঞ্চে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের বিষয়ে চিন এবং রাশিয়ার উদ্বেগ সত্ত্বেও ভারত এমন একটি যৌথ বিবৃতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যা যুদ্ধের মানবিক দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে তুলে ধরার পাশাপাশি রাশিয়ার সরাসরি নিন্দা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এই কূটনৈতিক কৃতিত্বই একটি ভূ-রাজনৈতিক সেতু নির্মাণকারী হিসাবে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কৌশলগত স্বাধিকার বজায় রেখে এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েই বিভিন্ন বিশ্ব শক্তির মধ্যে মধ্যস্থতা করা এবং আপস করার বিষয়ে ভারতের ক্ষমতার উপর জোর দেয়।
সাম্প্রতিক অতীতে, বিশেষ করে নয়াদিল্লিতে সাম্প্রতিক জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারত বিশ্ব মঞ্চে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের বিষয়ে চিন এবং রাশিয়ার উদ্বেগ সত্ত্বেও ভারত এমন একটি যৌথ বিবৃতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যা যুদ্ধের মানবিক দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে তুলে ধরার পাশাপাশি রাশিয়ার সরাসরি নিন্দা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
ইউক্রেনে বিদ্যমান যুদ্ধ ও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভারত ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার আর একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। প্রধানমন্ত্রী মোদী মস্কোয় প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে বিশেষ ও উল্লেখযোগ্য সুবিধাযুক্ত সম্পর্ককে আরও গভীর করেছেন। মস্কো থেকে তিনি সরাসরি অস্ট্রিয়ায় এসে পৌঁছন। ভিয়েনায় মোদী আবারও জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘এখন যুদ্ধের যুগ নয়।’ সম্মুখ সমরে নামার পরিবর্তে ‘আলোচনা ও কূটনীতি’র মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে কথা বলেন। মোদী এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়েও এই বাক্যাংশ ব্যবহার করেছিলেন। এবং এই বাক্যাংশকেই রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট সমালোচনা হিসাবে দেখা হয়েছিল। ভারত পশ্চিম এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে, নিজে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সেতু নির্মাণকারী হিসাবে অবস্থান করছে। বিশেষ করে চিনের বিরুদ্ধে নিজেকে জাহির করার ক্ষেত্রে এই কৌশল ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রেক্ষাপটে অস্ট্রিয়া ইউরোপে ভারতের জন্য একটি কৌশলগত গন্তব্য হিসেবে কাজ করে এবং ১৯৫৫ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রেখে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। বিদ্যমান উত্তেজনা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত। রুশ বিনিয়োগ, রুশ গ্যাসের উপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং বিস্তৃত আর্থিক শৃঙ্খলের কারণে এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণও বটে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল রাশিয়ায় অস্ট্রীয় ব্যাঙ্ক রাইফেইসেন ইন্টারন্যাশনালের কার্যক্রম। ইউক্রেনে বিদ্যমান যুদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গও বটে। ভারত এবং অস্ট্রিয়া উভয়ই রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ অনুসারে একটি ‘বিস্তৃত, ন্যায়সঙ্গত এবং দীর্ঘস্থায়ী’ শান্তির প্রয়োজনে সম্মত হয়েছে। গ্লোবাল সাউথে ভারত একটি অনন্য ও বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান বজায় রেখেছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিজের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করেছে। উপরন্তু, উভয় পক্ষই সন্ত্রাসবাদী হামলার ফলে সৃষ্ট বিপদ ও ঝুঁকি এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত সমাধানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তাদের অবস্থানে সহমত পোষণ করেছে। উভয় দেশই ইজরায়েলের জন্য তাদের রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি মস্কোয় তাদের জ্বালানি ও বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্যও পরিচিত।
উপসংহার
প্রধানমন্ত্রী মোদীর অস্ট্রিয়া সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জোরদার করার একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ করে দেয়। ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং ইতিবাচক জনসংখ্যাগত উন্নয়ন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে। অস্ট্রীয় সংস্থাগুলি এখনও পর্যন্ত সংখ্যা ও কার্যকলাপের সুযোগ দ্বারা উপস্থাপিত; ভারতের বিস্তৃত বিনিয়োগ কর্মসূচি বিশেষ করে অবকাঠামো এবং সবুজ প্রযুক্তিতে উপকৃত হতে পারে। ইইউ ও ভারতের মধ্যে পরিকল্পিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ইইউ অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশকে সহজতর করতে পারে এবং শ্রম অভিবাসনকে উত্সাহিত করতে পারে, যা অস্ট্রিয়া-সহ ইউরোপে শ্রম ঘাটতির কারণে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডোর অস্ট্রিয়া-সহ অতিরিক্ত বাণিজ্যের পথ খুলে দেবে এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে জোরদার করবে। এই ঘটনাপ্রবাহ প্রযুক্তি, স্থিতিশীল উন্নয়ন এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য বিস্তৃত সুযোগ প্রদান করে, যা থেকে উভয় দেশই দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হতে পারে।
এই প্রেক্ষিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে ভারত ও অস্ট্রিয়ার কৌশলগত স্বার্থের তুলনা একটি জটিল সমীকরণকেই তুলে ধরে। ভারত পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় শক্তি ব্লকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং বিকাশ করার ক্ষমতা-সহ নিজে একটি ভূ-রাজনৈতিক সেতু বন্ধনকারী হিসাবে অবস্থান করে। অন্য দিকে, একটি ছোট আকারের, ব্যাপক ভাবে রফতানিমুখী দেশ হিসাবে অস্ট্রিয়ার বিশেষ করে ভারতের মতো একটি বৃহৎ ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বৈচিত্র্যময় ও গভীরতর করে তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ইউরোপে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে অস্ট্রিয়ার অনন্য অবস্থান বা তার বিতর্কিত কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা, যেমন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পরে চ্যান্সেলর নেহামারের মস্কো সফর সত্ত্বেও দেশটিতে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাবের অভাব রয়েছে। এই ভাবে অস্ট্রিয়ার জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পথ খুলে দেয়, যা তার জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে। এই ভাবে যখন উভয় দেশ লাভের জন্য প্রত্যাশী, অস্ট্রিয়ার রফতানির উপর নির্ভরশীলতার কারণে এবং তার বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি প্রসারিত করার ইচ্ছার কারণে এই সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে যুক্তিযুক্ত ভাবে আরও চাপ বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে বইকি!
ভেলিনা চাকারোভা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.