৮ জানুয়ারি ভারতের বিদেশমন্ত্রকের সচিব বিক্রম মিসরি দুবাইতে তালিবান-নেতৃত্বাধীন ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তানের (আইইএ) ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মওলভি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। ভারত এবং আইইএ-র প্রতিনিধিদের মধ্যে এটি সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অবশ্যই, যেখানে একজন তালিবান নেতার সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কূটনীতিক সাক্ষাৎ করেছেন। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলার পরে এবং আফগানিস্তানের প্রতি ভারতের জোরালো সমর্থন দর্শিয়ে প্রকাশ করা বিবৃতিটি আসলে ইঙ্গিত করে যে, মনোভাবে ‘বদল’ আসার দরুন ভারত কী ভাবে এখন আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তালিবান কাবুলে ক্ষমতা দখল করার এবং তৎকালীন প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পতনের সূচনা করার সাড়ে তিন বছর পর আফগানিস্তানের প্রতি নয়াদিল্লির দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে বিবর্তিত হয়েছে।
বিদেশ মন্ত্রকের (এমইএ) তরফে প্রকাশিত সাংবাদিক বিবৃতি অনুসারে, বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে সামগ্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। ভারত ও আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে শক্তিশালী ভিত্তিগত সম্পর্কের কথা পুনর্ব্যক্ত করে ভারত দেশটিকে ‘মানবিক ও উন্নয়নমূলক সহায়তা’ প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। ভারত অদূর ভবিষ্যতেও এ হেন উন্নয়ন প্রকল্পে সম্পৃক্ত থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমনকি ভারত স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বস্তুগত সহায়তা, শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং ক্রিকেটের মতো ক্রীড়াক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারত বাণিজ্য বা পণ্য আমদানি-রফতানির উদ্দেশ্যে এবং আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা প্রদানের সুবিধার্থে চাবাহার বন্দরের গুরুত্বের উপরও জোর দিয়েছে। এর পাশাপাশি নয়াদিল্লি তার নিরাপত্তা উদ্বেগের প্রতি আফগান পক্ষের সংবেদনশীলতার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং উভয় পক্ষই বিভিন্ন স্তরে তাদের যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।
২০২১ সালের অগস্ট মাসে কাবুলে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে নয়াদিল্লির নীতিকে সর্বোত্তম ভাবে বিশিষ্ট এবং ক্রমবর্ধনশীল বলে বর্ণনা করা যেতে পারে, যেটি সেই সময়ে দেশটিতে কেমন পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছিল, তার দ্বারা আকার পেয়েছিল। যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লি প্রথমে হেরাত ও কান্দাহারে তার দূতাবাসগুলি বন্ধ করে দেয় এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েক জন আফগান নাগরিককে আগে থেকে দেওয়া ভিসা প্রত্যাহার করে কাবুলেও ভারতীয় দূতাবাসের দরজা বন্ধ করে দেয়। কাবুলের পতনের প্রথম মাসগুলিতে ভারত তালিবানকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করা এবং ভারতের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট উদ্বেগকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি ২০২১ সালের অগস্ট মাসে হয়েছিল, যখন কাতারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শের মহম্মদ আব্বাস স্তানেকজাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। নয়াদিল্লি তালিবানদের অন্তর্ভুক্তি অনুশীলন ও নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য অনুরোধ অব্যাহত রাখলেও তালিবান সদস্যদের এমইএ দ্বারা প্রদত্ত একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগদানের অনুমতি দেওয়ার খবর আসলে দর্শায় যে, ভারতের আফগান নীতিও বদলে গিয়েছে।
এই সমস্ত দেশের নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে এবং তাদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা নয়াদিল্লিকে নিজের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত অবনতিশীল সম্পর্কের কারণে নয়াদিল্লি নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের আফগানিস্তান দূতাবাসও একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পর প্রজাতন্ত্র যুগের কূটনীতিকরা দূতাবাস ত্যাগ করেন এবং ভারতের তরফে সমর্থনের অভাব ও তালিবানের চাপ বৃদ্ধির কারণে কার্যকর ভাবে নিজেদের কাজ সম্পাদন করতে অক্ষমতার কথাও জানান। মুম্বই ও হায়দরাবাদের দূতাবাসগুলিও পরবর্তী সময়ে তালিবানের নিয়ন্ত্রণে আসে। গত সাড়ে তিন বছরে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পৃক্ততা পরিসংখ্যানের দিক থেকেও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে আফগানিস্তান আঞ্চলিক সহযোগিতা উদ্যোগে অংশ নিয়েছিল এবং তালিবানের প্রতিনিধিরা ভারতের টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটির বৈঠকে অংশগ্রহণ করে।
দুবাইয়ে বৈঠকের কয়েক দিন আগে ভারতের বিদেশসচিব ইরানের রাজনৈতিক বিষয়ক উপ-বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেন। উভয় দেশই আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য চাবাহার বন্দরের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে।
বন্দরটির উন্নয়ন ও তা পরিচালনার জন্য ২০২৪ সালের মে মাসে ইরান ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির পরপর এ হেন বৈঠকের ঘটনা ঘটে। এটি পাকিস্তানের করাচি ও গোয়াদর বন্দরের উপর আফগানিস্তানের নির্ভরতা কমাতে এবং দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বন্দরটির সুবিধা নেওয়ার জন্য উভয় পক্ষের ক্রমবর্ধমান তাগিদকেই দর্শায়। মানবিক ক্ষেত্র থেকে উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রে সহায়তা প্রসারিত করার ভারতের সিদ্ধান্তও আসলে আফগান জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসার জন্য নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান সদিচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।
তালিবান-নেতৃত্বাধীন আইইএ-তে ভারতের প্রসারের নেপথ্যে থাকা অনুপ্রেরণা আসলে কী, তার উপর আলোকপাত করলে দু’টি দৃষ্টিভঙ্গির কথাই স্পষ্ট হয়। এক দিকে, ২০২১ সালে সে দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে নয়াদিল্লি আফগানিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসবাদের হুমকির বিষয়ে ভীষণ সচেতন। আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে তালিবানের প্রকাশ্য বা গোপন সমর্থন জোগানোর বিষয়ে উদ্বেগ এবং বিশেষ করে লস্কর-ই-তইবা (এলইটি) ও জইশ-ই-মহম্মদ-এর (জেএম) মতো ভারতের প্রতি শত্রুমনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলি নয়াদিল্লির বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এই ধরনের গোষ্ঠীগুলির উপস্থিতি ও ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশের (আইএসকেপি) ক্রমবর্ধমান হুমকির কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্লেষণাত্মক সহায়তা ও নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ দলের প্রতিবেদন এ হেন ভয়কে আরও জোরদার করে তুলেছে। তাই ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হয়ে উঠেছে হুমকি হিসেবে (আবারও) আফগানিস্তানের উত্থানকে প্রতিহত করা। তাই আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা খানিক ভারতীয় নিরাপত্তা বাধ্যবাধকতা থেকেই উদ্ভূত।
অন্য দিকে, এই অঞ্চলের স্থিতাবস্থা কাবুল প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততার উপর নিয়ন্ত্রণের দাবি রাখে, যাতে সে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি বিশেষ প্রভাব খাটাতে না পারে। নয়াদিল্লি তাই সক্রিয় ভাবে পরিবর্তিত আফগানিস্তানে তার বাজি সুরক্ষিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তালিবানদের প্রত্যাবর্তনের পর থেকে রাশিয়া, চিন, ইরান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং এমনকি তাজিকিস্তানের মতো এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশও তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই সমস্ত দেশে আফগান দূতাবাসগুলি তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান উভয়েই তালিবানকে তাদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। একই সময়ে, রাশিয়ার পার্লামেন্ট সম্প্রতি এমন একটি আইন পাস করেছে, যার ফলে রাশিয়া নিজেদের সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর তালিকা থেকে তালিবানের মতো গোষ্ঠীগুলিকে সরিয়ে দেবে। অন্য দিকে, চিন তার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়েছে এবং উভয় পক্ষের নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ, খনিজ ও অন্যান্য খনির চুক্তি স্বাক্ষর, আইইএ-র সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক ও চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা করেছে। এই সমস্ত দেশের নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে এবং তাদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা নয়াদিল্লিকে নিজের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত অবনতিশীল সম্পর্কের কারণে নয়াদিল্লি নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে।
তালিবান ভারতকে ভিসা ব্যবস্থা উদার করার আহ্বান জানিয়েছিল এবং বলেছিল যে, বিশেষ করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি হ্রাসের বিষয়ে আফগানিস্তানের পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছে ভারত। ভারতীয় সাংবাদিক বিবৃতিতে এ কথার অবশ্য কোনও উল্লেখ না পাওয়া গেলেও ভারতের সঙ্গে আরও সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার কাবুলের ক্রমবর্ধমান অভিপ্রায়ের কথা স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
২০২৪ সালের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালায় এবং বিশেষ করে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সদস্যদের লক্ষ্য করে এ হেন হামলা চালানো হয়েছিল। কারণ তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে দলটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবিরাম আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের মতে, এ হেন হামলা বেসামরিক নাগরিকদের প্রভাবিত করেছে এবং পাকতিকা প্রদেশে ৫১ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। ভারত ৬ জানুয়ারি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে পাকিস্তানের নিন্দা করে এবং তাদের সমস্যার জন্য প্রতিবেশীদের দোষারোপ করে। সংঘর্ষ হওয়ার প্রায় একই সময়ে দুবাইয়ে হওয়া বৈঠকের পর আফগানিস্তানের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে ভারতের বিবৃতির উদ্দেশ্য ছিল এ কথাই বোঝানো যে, আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা আসলে অঞ্চলটিতে পাকিস্তানকেই আরও কোণঠাসা করে দেবে।
আইইএ-র বিদেশমন্ত্রকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তালিবান ভারতকে একটি ‘প্রধান অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক শক্তি’ হিসাবে তুলে ধরেছে এবং ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে তাদের সদিচ্ছার কথা প্রকাশ করেছে। তালিবানদের মতে, আফগানিস্তান কোনও দেশের জন্যই হুমকি নয়। তারা ভারতকে ভিসা ব্যবস্থা উদার করার আহ্বান জানিয়েছিল এবং বলেছিল যে, বিশেষ করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি হ্রাসের বিষয়ে আফগানিস্তানের পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছে ভারত। ভারতীয় সাংবাদিক বিবৃতিতে এ কথার অবশ্য কোনও উল্লেখ না পাওয়া গেলেও ভারতের সঙ্গে আরও সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আইইএ-র ক্রমবর্ধমান অভিপ্রায়ের কথা স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
তালিবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার পরেও অন্য আঞ্চলিক দেশগুলির পাশাপাশি ভারতের মতে, আফগান জনগণের অবস্থা এখনও ভয়াবহ। আফগানিস্তানের শাসনব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ নীতিগুলির উপর যে ভাবে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে অন্যান্য দেশের স্বার্থও নেতিবাচিক ভাবে প্রভাবিত হতে পারে। ভারতের কাছে এখন নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য আরও সুযোগ থাকলেও নয়াদিল্লিকে তালিবানের সঙ্গে সেই সকল আফগান জনগণের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা চালানোর পথ খুঁজতে হবে, যারা আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ওপেন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.