২০২১ সালের আগস্টের শেষের দিকে তালিবানের কাবুল দখল, এবং তারপর আফগানিস্তানে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর গুরুতর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে গত ২০ বছরে মহিলা ও মেয়েদের যাবতীয় অর্জন আবার হারিয়ে যাবে। আফগানিস্তান ফের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার পর তালিবান প্রতিনিধিরা তাঁদের অসংজ্ঞায়িত ইসলামিক কাঠামোর মধ্যেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কাজ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের অধিকারকে সম্মান করার। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সরকারের সক্রিয়তা থেকে এ কথাই স্পষ্ট হচ্ছে যে মহিলা ও মেয়েদের নিপীড়নের জন্য ক্ষমতা ব্যবহারের প্রশ্নে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীটি আবার স্বমূর্তি ধারণ করেছে।
নিয়ন্ত্রণ ফের হাতে তুলে নেওয়ার পর থেকে তালিবান কর্তৃপক্ষ মহিলা ও মেয়েরা কোথায় কোথায় যেতে পারবেন তা কঠোর ভাবে সীমাবদ্ধ করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে নারীদের জানানো হয়েছে যে তাঁরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কর্মক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও যেতে পারবেন না। গত তিন মাস ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি, এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মহিলা ও পুরুষদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ফলে মাধ্যমিক-উত্তর প্রতিষ্ঠানগুলিতে মেয়েদের যোগ দেওয়ার সুযোগ নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে৷ মিডিয়া ও বিনোদন ক্ষেত্র সহ কাজের অনেক জায়গা থেকে মহিলাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। আফগানিস্তানে মহিলা ও মেয়েদের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার জন্য অক্টোবরে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তালিবানের কড়া নিন্দা করেছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে নারীদের জানানো হয়েছে যে তাঁরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কর্মক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও যেতে পারবেন না।
তালিবান কর্তারা গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকারদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলি বন্ধ করতে বাধ্য করেছেন, এবং তার ফলে আক্রান্তরা জরুরি সহায়তা ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ‘‘অনেক আক্রান্ত, এবং সেই সঙ্গে আশ্রয় কর্মী, আইনজীবী, বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা পরিষেবার সঙ্গে জড়িত অন্যরা এখন হিংসার শিকার হওয়া ও মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।’’ ডিসেম্বরের শুরুতে তালিবান সৈন্যরা কান্দাহারে কানাডিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর জন্য কাজ করেছিলেন এমন একজন আফগান ব্যক্তির ১০ বছর বয়সী মেয়েকে, এবং মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কিত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাকে, গুলি করে হত্যা করেছিল।
সরকারের মহিলা বিষয়ক মন্ত্রককে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে সুকৃতি প্রচার ও দুষ্কৃতী দমন মন্ত্রক দিয়ে, এবং মন্ত্রিসভায় কোনও মহিলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
পূর্ববর্তী তালিবান শাসনের সময়, ‘সুকৃতি উন্নয়ন মন্ত্রক’ কব্জি ও গোড়ালি সহ তাঁদের সমস্ত শরীর পোশাক দিয়ে ঢেকে না–রাখলে বা ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাইরে বেরোলে মহিলাদের মারধর করত। মহিলারা এখন তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমশ বেশি করে ভয় পাচ্ছেন।
তালিবান সৈন্যরা কান্দাহারে কানাডিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর জন্য কাজ করেছিলেন এমন একজন আফগান ব্যক্তির ১০ বছর বয়সী মেয়েকে, এবং মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কিত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাকে, গুলি করে হত্যা করেছিল।
উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অন্তর্দৃষ্টি পেতে টরন্টো-ভিত্তিক গ্লোবাল ডেটা কালেকশন সংস্থা আরআইডব্লিউআই আফগানিস্তানের মানুষের কাছ থেকে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না–করে এবং পরিচয় গোপন রেখে রিয়েল-টাইম সেন্টিমেন্ট ডেটা সংগ্রহ করে একটি গবেষণা শুরু করেছে[1] ৷ সংস্থাটি ২৭ আগস্ট থেকে ১ নভেম্বর, ২০২১-এর মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ১২,০০০ জনেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে র্যান্ডম ডোমেন ইন্টারসেপ্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এই প্রযুক্তি এই বিষয়টি নিশ্চিত করে যে ইন্টারনেট সার্ফিং করা যে কেউ নিজের ডিভাইসের ধরন নির্বিশেষে সমীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। আফগানিস্তানের ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষের ইন্টারনেট সংযোগ আছে।
স্কুলে পড়ার বয়সী মেয়ে রয়েছে এমন যে সব পরিবার সমীক্ষায় অংশ নিয়েছে তাদের দুই-পঞ্চমাংশেরও বেশি জানিয়েছে যে সেই মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে না। এর মধ্যে, ৪১ শতাংশ বলেছে যে তাদের এলাকায় মেয়ে/মহিলাদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, এবং আরও ২৯ শতাংশ বলেছে যে মেয়ে/মহিলাদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও তাঁদের জন্য তা নিরাপদ ছিল না। তালিবান আবার ক্ষমতায় আসার আগেই দেশের গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের বিপদ ছিল, আর এখন তালিবান কিশোরী মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা দেওয়ায় সেই বিপদ আরও বাড়ছে।
৬০ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে মহিলারা তাঁদের এলাকায় নিরাপদে কাজ করতে পারছেন না, এবং তাঁদের ৬৩ শতাংশ বিশ্বাস করেন যে অদূর ভবিষ্যতেও অবস্থা তাঁদের জন্য বিপদসঙ্কুলই থাকবে (নীচে দেখুন)।
তালিবান আবার ক্ষমতায় আসার আগেই দেশের গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের বিপদ ছিল, আর এখন তালিবান কিশোরী মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা দেওয়ায় সেই বিপদ আরও বাড়ছে।
আরআইডব্লিউআই সমীক্ষার ডেটা আফগানিস্তানের মানুষ ও আফগান শরণার্থীদের কাছ থেকে আগেই যা জানা যাচ্ছিল সেই তথ্যগুলোই আবার জোরালো ভাবে সামনে নিয়ে এল, এবং তা থেকে স্পষ্ট সে দেশে নারী ও মেয়েদের জন্য পরিবেশ ক্রমশই আরও বেশি করে প্রতিকূল হচ্ছে। তাঁদের অধিকার খর্ব করা এবং সুযোগ দিতে অস্বীকার করার ঘটনা ঘটছে একটি পুরোদস্তুর মানবিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে। এ এমন এক সংকট যার প্রভাব অনেক বেশি করে পড়ে নারীদের উপর।
আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, এবং পাহাড়ি দেশটিতে শীতের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। নিঃস্ব পরিবারগুলোকে দারিদ্র্য বাধ্য করছে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিতে। উদ্বেগজনক ঘটনা হল আরআইডব্লিউআই সমীক্ষার উত্তরদাতাদের ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছেন তালিবানের কারণে তাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এবং অর্ধেকেরও বেশি বলেছেন যে তাঁরা তালিবানের কাজকর্মের কারণে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন বা ছাড়ার চেষ্টা করেছেন।
এই সমীক্ষার ফলাফলগুলি একথা স্পষ্ট করে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও অনেক বেশি করে প্রতিক্রিয়া না-জানালে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, আর সেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে মেয়ে ও মহিলাদের৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও তাদের মিত্রদের অবশ্যই অবিলম্বে মানবিক সহায়তা বাড়াতে হবে, সে দেশের ভেঙে–পড়তে চলা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার পতন রোধ করতে হবে, এবং তালিবান নেতাদের ক্রমাগত চাপ দিতে হবে মেয়ে ও মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার এবং শ্রমবাজার ও নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার সহ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষা করার জন্য।
বার্ট ডব্লিউ ইডেস হচ্ছেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপমেন্ট–এর প্রফেসর অফ প্র্যাকটিস, এবং কানাডার এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের বিশিষ্ট ফেলো। আরআইডব্লিউআই–এর গ্লোবাল রিসার্চের প্রধান ড্যানিয়েল গোল্ডফার্ব এই নিবন্ধে উদ্ধৃত সমীক্ষার তথ্য সরবরাহ করেছেন।
[1] গড়ে ১৮৩ জন উত্তরদাতা প্রতিদিন অংশগ্রহণ করেছেন। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশ থেকেই উত্তরদাতাদের মতামত এসেছে। প্রতিটি প্রশ্নে উত্তরদাতার সংখ্যা ৭২১ থেকে ১২,২০৪ পর্যন্ত।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.